কথায় বলে–বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি একবার বের হয়ে গেলে আর ফেরানো যায়না। একবার কথা দিয়ে ফেলার পরে আর কিছু করার ছিল না ঠাকুরদার। তাই নিজের গাট থেকে প্রতিটা শাড়িতে আড়াই টাকা করে ভর্তুকি দিয়ে, পুঁজিপাটা সব শেষ করে বরিশাল শহর থেকে সেই যে ফিরে এলেন, আর কোনদিন ওমুখো হননি।
ঠাকুরদার এই বুদ্ধিমত্তার খবর খুব বেশিদিন গোপন ছিল না। বরিশাল শহরে তো আরও এক দুজন ব্যাপারী যায়, যখন মানুষ ঠাকুরদার এই ব্যবসা বৃত্তান্ত অবগত হল–তারা প্রচুর হেসে ঠাকুরদার নামের পিছনে বসিয়ে দিল ব্যাপারী পদবি। যে কারণে আমি মনোরঞ্জন মণ্ডল নই, মনোরঞ্জন ব্যাপারী। এই হল ব্যাপারী হবার আসল ব্যাপার।
এই দেশে মনোরঞ্জন অনেক আছে। খুঁজলে ব্যাপারীও দুপাঁচটা মিলে যাবে। কিন্তু মনোরঞ্জন ব্যাপারী আর একজনও পাওয়া যাবে না। আমিই এক এবং এককও আমিই আদি এবং আমাতেই অন্ত।
সেদিন যখন আমার বাবা চালের পোটলা নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছিলেন তার অল্প কিছুক্ষণ আগে মাতৃ জঠর থেকে ধরণীর মৃত্তিকায় অবতরণ করেছি আমি। বাবার এক খুড়িমা-যিনি আমার বাবারও জন্মের সময় ধাত্রীর ভূমিকায় ছিলেন, এখন আমার জন্মের সময়ও সেই একই ভূমিকা পালন করলেন। বাঁশের চটা দিয়ে নাড়ি কেটে ধুয়ে মুছে ন্যাকড়া জড়িয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন আমাকে আমার মায়ের পাশে। বাবা এলে তখন সেই “খুড়িমা” বাবাকে বলেছিলেন একটু মধু যোগাড় করে আনতে। আমাদের সমাজের প্রবীণ মানুষদের বহু পুরাতন এক বিশ্বাস, নতুন মানুষ পৃথিবীতে এলে তার মুখে মধু দিতে হয়। তা না হলে জাতকের জীবন মধুময় হয় না। তিক্ত বিষাক্ত হয়ে রয়ে যায়। বাবা তখন খুব কেঁদেছিলেন। কারণ যে ঘরে চালই নেইমধু আসবে কোথা থেকে? বাবার জন্মের সময়ও তার মুখে মধুর ফোঁটা পড়েনি। মধু বঞ্চিত জীবন যে কত কষ্টের, গ্লানি আর অপমানের তিনি তা মর্মে মর্মে জানেন। কিন্তু তখন সেই প্রবল কালবৈশাখির ঘনিয়ে ওঠা দুর্যোগে কোথায় যাবেন মধুর সন্ধানে! ফলে আমার আর মুখে মধুপাত হল না। জীবন সুমধুর হল না। হতভাগ্য দলিত বাপের অভাগা ছেলে রয়ে গেল মধু বঞ্চিত এক তিক্ত জীবন পথের যাত্রী হয়ে।
.
আমার বাবা তার জাতি পরিচয় দিতে গিয়ে বড়ই গর্ব আর অহংকারের সঙ্গে বলতেন “মোরা নোমোশুদুর, কাশ্যপ গোত্র”। যদিও উচ্চবর্ণের লোকেরা আমাদের অচ্ছুত অস্পৃশ্য ভাবতো, চরম ঘৃণাভরে চাড়াল চণ্ডাল এই সব বলত। বাবা বা আমাদের সমাজের কোনও মানুষ কিন্তু নিজেদের চণ্ডাল বলে স্বীকার করতে চাইত না। তাদের দাবি ছিল, আমরা উঁচু জাত। ব্রাহ্মণের রক্ত আছে আমাদের শরীরে এবং এটা শুধু মাত্র নমঃশুদ্র মানুষেরাই নয়, বর্ণবাদী ব্যবস্থায় সর্বনিম্নধাপে অবস্থানরত প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠিই দাবি করে। তাদের প্রত্যেকের নিজের হীনমন্যতা আড়াল করে আত্মগর্বে স্ফীত হবার মত একটা লোক গাঁথা প্রচলিত আছে। নমঃশূদ্র সমাজেও এই রকম একটা গল্প প্রাচীনকাল থেকে প্রবহমান।
বিশ্বস্রষ্টা ব্রহ্মার এক পুত্রের নাম মারিচ। মারিচের এক পুত্রের নাম কাশ্যপ সেই কাশ্যপ মুনির এক পুত্রের নাম নমস মুনি। নমস মুনির বিবাহ হয় ব্রহ্মার এক মানস পুত্র রুচির কন্যা সুলোচনার সাথে। সেই কন্যার গর্ভে নমস মুনির ঔরসে দুটি যমজ পুত্রের জন্ম হয়। যার একজনের নাম রাখা হয় উরুবান আর একজনের কীর্তিবান। পুত্রদ্বয়ের জন্মের কিছুকাল পরে নমস মুনি বনে চলে যান তপস্যা করতে। সেই তপস্যায় উনি এমন নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে দিনমাস বছরের কোন হিসেব রাখতে পারেন না। এভাবে পার হয়ে যায় চৌদ্দ বৎসর।
শাস্ত্রানুসারে সব মানুষই জন্মমাত্রেই শুদ্র। এরপর উপনয়ন দ্বারা সে হয় দ্বিজ। আর তারপর অধ্যয়ন ও সাত্বিক তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হলে তখন হয় ব্রাহ্মণ। ডাক্তারের পেটে জন্মালেই যেমন ডাক্তার হওয়া যায় না, সেই কালে ব্রাহ্মণের ঔরসে জন্মালেই ব্রাহ্মণ হবার সুযোগ ছিল না। কঠিন শ্রমে তাকে তা অর্জন করতে হত। বিদ্বান হবার প্রথম ধাপ যেমন বিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশ, ব্রাহ্মণত্বের দিকে অগ্রগমনের প্রথম ধাপ উপনয়ন। যা দিতে হবে চৌদ্দ বছর অতিক্রান্ত হবার পুর্বে। নমস মুনির অসাবধানতায়বালকটির সে বয়স তখন পার হয়ে গেছে। এখন কী উপায়! এরা যে শূদ্র রয়ে গেল। তবে নমস মুনির পুত্র বলে কথা। শূদ্র হলেও এরা নমস্য। তাই এদের নাম হল নমঃশূদ্র।
এত গৌরবময় যাদের অতীত আজ তাদের এমন দীনহীন দশা কেন! মাথায় তেল, পেটে ভাত, পরনের ত্যানা, পায়ের চপ্পল, ঘরের চালে খড় কিছুই কেন নেই! কেন এত লাঞ্ছনা অপমান অত্যাচার?–আছে। নমঃশূদ্র মানুষের কাছে সেই প্রশ্নের উত্তর আছে।
পাল রাজত্ব শেষ আর সেন রাজত্ব শুরু এর মাঝে অল্প কিছু কাল বঙ্গদেশের কোন এক অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা শুর বংশের রাজা আদিশূরের অধিকারে ছিল। উচ্চবর্ণের ঐতিহাসিকরা যার কথা বিশেষ কারণে লিপিবদ্ধ করেননি। পাল রাজারা সবাই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এদের প্রচেষ্টায় সমগ্র বঙ্গদেশ তখন প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের বন্যায়। যখন পাল রাজত্বের পতন ঘটে গেছে, তখন রাজা আদিশূর বৈদিক ধর্মের পুনরুত্থান প্রচেষ্টায় এক মহাযজ্ঞ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। কিন্তু যজ্ঞ করতে হলে তো বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ চাই। বঙ্গে তখন আর তেমন ব্রাহ্মণ কোথায়! বৌদ্ধ ধর্মে তো কোন পূজাপাট হোমযজ্ঞ নেই। রাজ্যবাসীরা কেউ সে সব করে না। ফলে দীর্ঘ অনভ্যাসে ব্রাহ্মণরা মন্ত্রতন্ত্র সব ভুলে বসে আছে।