মায়ের মুখে শুনেছি সেদিন আমাদের ঘরে রান্না করবার মত একদানা চালও ছিল না। জনমজুরি দ্বারা সংসার প্রতিপালন করা আমার বাবা–যে নাকি মোষের মত খাটতে পারত, তার সে সব দিনে কোন কাজ ছিল না। যার ফলে তিন-চার দিন আগে থেকে আমাদের রান্নাঘরের উনুন জ্বালা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছিল। আশেপাশের মানুষ যারা আমাদের স্বজাতি, আত্মীয়, তারাও সব আমাদের মতোই হতদরিদ্র-দিন আনা দিন খাওয়া লোক। তাদের কারও ঘরে দয়া জিনিসটার তখন পৰ্যন্ত অবলুপ্তি ঘটেনি। তাই তাদের কেউ কেউ একটু কম খেয়ে নিজের ভাগ থেকে একমুঠো ভাত বাঁচিয়ে আমার মাকে দিয়ে যেত। এইভাবে গর্ভস্থ সন্তান নিয়ে কোনভাবে বেঁচে ছিল এক গ্রাম বাংলার ভাগ্যাহত গৃহবধূ।
সেদিন সকাল বেলা আমার বাবা মুখে জল না দিয়েই বের হয়ে পড়েছিলেন পথে, কোথায় কিছু চাল পাওয়া যায় সেই সন্ধানে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন পরিবার ছিল জনৈক ভটচাজ বাবুরা। মায়ের মুখে শুনেছি, চাষের পরে তাদের খামারে চার চারটে ধানের গাদা মারা হত। সে এতবড় আর এত উঁচু যে ধান গাদার মাথার দিকে তাকালে মহিলাদের মাথা থেকে নাকি ঘোমটা খসে পড়ে যেত। বাবা সেই বাড়িতে গিয়েছিলেন কিছু চাল ধার পাবার আশায়।
এরা অঞ্চলের গরিব মানুষকে বিপদের সময় ধান চাল নগদ টাকা ধার দেয়। সে ধার চাষের মরশুমে খেটে পরিশোধ করতে হয়।
কিন্তু এখন সময়টা একটু অন্য রকম। মাত্র বছর চার-পাঁচ আগে দেশভাগ হয়ে গেছে। এ সময়ে দলে দলে লোক দেশ ছেড়ে “ইন্ডিয়ায়” পালাচ্ছে। ভটচাজ পরিবারের কিছু লোক ইতিমধ্যেই ওদেশে চলে গেছে। বাকি যারা আছে আজ যাই কাল যাই করছে। এত জমি জায়গার একটা যথাযথ ব্যবস্থা করে যাওয়া সোজা ব্যাপার তো নয়। এই সময় ধার দিলে তা আর আদায় করা যাবে কিনা কে জানে! সেই জন্য তারা চালের বিনিময়ে তখনই কিছু কাজ করিয়ে নেওয়া উচিং মনে করে বাবাকে দিয়ে একটা আমগাছ কাটিয়ে কাঠের চলা–যা দিয়ে রান্না করা হয়, তা বানিয়ে নেয়।
এ যেন সেই মুনশি প্ৰেমচাঁদের আর এক গল্প অন্য এক পটভূমিতে। তবে সেই গল্পের প্রধান চরিত্রের মত ক্ষুধা তৃষ্ণা পরিশ্রমে বাবাকে প্রাণ হারাতে হয়নি। কাজ শেষ করে গামছার পোটলায় কিছুটা চাল বেধে তিনি ঘরে ফিরে আসতে সক্ষম হন। সারা দিন পরে যখন তিনি ঘরে ফেরেন তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আর আকাশ কালো করে ধেয়ে আসা শুরু করেছে কালবৈশাখি ঝড়ের আভাস। যা কিছুক্ষণ পরে এক ভীষণ তাণ্ডব শুরু করবে এ অঞ্চল জুড়ে।
আমি মা বাবার প্রথম সন্তান। আমার পরে আরও দু ভাই দু বোনের জন্ম হয়। তখনকার দিনে নিয়ম ছিল বধূ তার প্রথম সন্তানের জন্ম দেবে মাতৃগৃহে। সে সময় খুব ছোট্টবেলায় মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। আর অল্প বয়েসে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বহু মেয়ে মারাও যেত। যে কারণে ওই নিয়ম। পাছে দোষ না পড়ে “প্রসুতির ঠিক মত সেবা শুশ্রূষা করেনি শ্বশুর শাড়ির লোক।” দুর্ভাগ্য, আমার মায়ের কোন মাতৃগৃহ ছিল না। আমার দিদিমা ছিলেন বাল্য বিধবা। তিনি বারো বছরে বিবাহ এবং ষোল বছরে মা হন। তারই কিছুদিন পরে আমার মাতামহ মারা যান। তখন দিদিমার ভরণ পোষণের ভার নেবার মত আর কেউ না থাকায় তিনি তার শিশু কন্যাটিকে নিয়ে নিজের মাতৃগৃহে চলে আসেন। যেখানে আগে ভাগে তার পাঁচ বোন বিধবা হয়ে এসে বসে আছে। সে কারণে অঞ্চলে এই বাড়িটার নাম “বিধবা বাড়ি” হয়ে গিয়েছিল। এই ছয় বোনের সন্তান ছিল মাত্র দুটি। আমার মা আর তার এক মাসতুতো দাদা।
আমার দিদিমা মাকে তার বোনদের হেপাজতে রেখে গ্রামের সম্পন্ন লোকদের বাড়ি চাল চিড়ে কুটে, কাঁথা সেলাই করে, মুড়ি ভেজে, যা সামান্য মজুরি পেতেন তা দিয়ে মা মেয়ে কোনভাবে বেঁচেবর্তে ছিলেন। যখন এই মেয়ের বয়স আট কি নয়, তখন সেই বাড়ির সামনের বড় গাঙ বেয়ে নৌকো নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন আমার ঠাকুরদা। হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটি ছোট্ট মেয়ে পিঠময় একরাশ কালো চুল নিয়ে জলঘাটে জল ভরছে তার ছোট্ট ঘটিতে। তখনই তিনি নৌকা থামিয়ে পাড়ে উঠে পড়লেন। খোঁজ নিলেন মেয়েটি কার! আর তারপর মেয়ের অভিভাবকদের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে ফেললেন। এবং একদিন এককুড়ি একটাকা কন্যাপন দিয়ে বধু করে নিয়ে এলেন সেই মেয়েকে তুরুকখালি গ্রামের বিখ্যাত “আট ভাইয়ের বাড়ি”-ব্যাপারী বাড়িতে।
আমাদের পূর্ব পদবি ছিল মণ্ডল। ঠাকুরদার কারণেই আমাদের সেই পদবিটি খসে যায়। তার একবার শখ হয় তিনি ব্যবসা করবেন। সেই মনোস্কামনায় এক নৌকা সুপারি নারকেল নিয়ে বরিশাল শহরে যান। তা ব্যবসা মোটামুটি খুব একটা মন্দ হয় না। তাই শহর থেকে ফেরার সময় বউয়ের জন্য দশ টাকা দামের একখানা শড়ি কিনে ফেললেন। সেই শাড়ি দেখে গ্রামের লোকের মুখে তো আর রা সরে না। একজন জানতে চায়–“কত দিয়া কেনলা শাড়িখান?” তখন দাম বলতে গিয়ে সতর্ক হল ঠাকুরদা। লোকে বলে “উনি যদি কিছু বেঁচেন–ঠকেন আট আনা। যদি কিছু কেনেন ঠকেন ষোল আনা। সেই কথা মনে পড়ে যাওয়ায় সঠিক দাম বলতে ইতস্তত করেন। কে জানে এবারও ঠকে এসেছেন কিনা! অবশেষে অনেক ভেবে শেষে বলেন তিনি–”দোকানদার আট টেহা চাইছিল। কইয়া বইলা সাড়ে সাতে আনছি। এয়ার কোমে হালায় পো হালায় কিছুতে দিতে রাজি হইল না।” বলে লোকটা–“তুমি মিছা কতা কওনা তো?” ঠাকুরদা জোরের সাথে জবাব দেয়, মিছা কতা কইয়া আমার কী লাভ! আমি যদি কই দশ টেহায় আনছি কেউ কী তা মাইনা নেবে? তখন মুচকি হেসে বলে সেই লোকটা–“ওই দামে মোরে এ্যাকখান এই শাড়ি আইন্যা দিবা?” “এ্যাকখান কি, কও যদি তো দশখান আইন্যা দিমু” বলে ঠাকুরদা। যথারীতি ঠাকুরদা পরের বার যখন সুপারি নারকেল নিয়ে বরিশাল যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠেছেন, দেখেন, কেউ সাড়ে সাত কেউ পনেরো টাকা নিয়ে ধেয়ে আসছে তার দিকে। সবারই একটা দুটো শাড়ি দরকার। সংখ্যায় তারা অনেক।