এরপর যুবা বয়স! রেল স্টেশনে মোট বওয়া, মাথার উপর এক পাঁজা ইট নিয়ে বাঁশের ভারা বেয়ে দোতলা তিনতলার ছাদে ওঠা, রিকশা চালানো, রাত জেগে পাহারাদারি, দুর পাল্লার ট্রাকের খালাসি, মেথর ডোম–এ ভাবেই কেটেছে আমার যুবা বয়স। এর কোন না কোন পর্বে পথে ঘাটে হাটে মাঠে কখনো না কখনো আপনি আমাকে নিশ্চয় দেখে থাকবেন। বলা যায় না হয়তো দেখে থাকবেন সেই উত্তাল সত্তর দশকে পাড়ার গলিতে বোমা পাইপগান নিয়ে ছুটে বেড়াতে। অথবা হাতে হাতকড়ি পড়িয়ে পুলিশ মারতে মারতে ভ্যানে তুলছে।
জীবন আমার পায়ের তলায় সরষে রেখে দিয়েছিল। তাই কোথাও কোন ভূমিকায় দুদিন স্থির দাঁড়াতে পারিনি। বারবার পিছলে গেছি। সেই পেছল খাওয়া-পিছিয়ে পড়া, পিছু হটা এক জীবনকথা আপনাকে শোনাতে বসেছি। সারা জীবনে “জীবন” আমাকে দিয়ে কত কিছু যে করিয়েছে, চাইলেও তার সব কথা কী লিখতে পারবো? আত্মজীবনীর এই এক মস্ত অসুবিধা কোন আড়াল থাকে না। সে আড়াল উপন্যাসে পাওয়া যায়। তাই অকপটে অনেক কথা বলে দেওয়ায় অসুবিধা থাকে না।
আত্মজীবনী লেখার আর একটা বিড়ম্বনা, নিজের ঢাক নিজে বাজাতে হয় নিজের চোখে সব মানুষই সুন্দর। নিজের কাজ সব মানুষের কাছে প্রশংসার। তাই ভয় হচ্ছে, আমার ছেঁড়া ফাটা বেসুর বেতাল ঢাকের বাজনা শুনে বিরক্ত না হয়ে যান। কারণ যে ছবি আমি এখন আঁকতে চলেছি আপনিও তো সেই সময়-সমাজের মানুষ। কে জানে আমার কোনও অভিযোগের আঙুল আপনার দিকেও উঠে যাবে কিনা!
ঠিক জানিনা কে যেন বলেছেন জীবন নাকি এক যাত্রা। জন্ম থেকে এক পা এক পা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা। আর আঘাতে ঠোক্করে ক্ষত বিক্ষত হয়ে–পথের বাঁকে বাঁকে রক্ত ছড়িয়ে যেতে যেতে সেই অমৃত পরশের অনুসন্ধান করা, যা জীবনকে সমৃদ্ধ করে। মহান করে, অমরত্ব দেয়।
সবাই সে অমৃত পায় না। কেউ কেউ পেয়ে যায়। যে পায় তার জন্ম সার্থক মৃত্যু সার্থক জীবন সার্থক। আপনি যদি আমাকে অহংকারী না ভাবেন তবে সবিনয়ে বলি, আমি সেই অমৃত স্পর্শ পেয়েছি। তাই একথা উচ্চারণ বোধহয় ধৃষ্টতা হবে না যে আমার জীবনটা সার্থক না বলা গেলেও একেবারে ব্যর্থ এটা বলা যাবে না। অবশ্য আমার সত্যিকারের সার্থকতা বা বিফলতা বলতে ঠিক কি বোঝায় এ বিষয়ে পরিষ্কার কোন ধারণাও নেই।
জন্মগত কারণে অপরাধী ঘোষিত অচ্ছুত অস্পৃশ্য এক দলিত পরিবারে আমার জন্ম। যার জীবন শুরু হয় ছাগল চড়ানো দিয়ে, তারপর দুবেলা দুমুঠো অন্নের তাড়নায় কত ধরনের “হীন নীচ জঘন্য বৃত্তি”। স্কুলে যাবার কোনও সুযোগ ঘটে না কিন্তু জেলযাত্ৰা ঘটে যায় বেশ কয়েকবার। সেই মানুষ যাকে “মানুষ” পৃথিবীর জঞ্জাল মনে করে মেরে ফেলারও চেষ্টা করেছিল কয়েকবার, আজ তাকে যখন মঞ্চে বসিয়ে মালা দেওয়া হয়, সে মনে করতেই পারে জীবন তাকে একেবারে বঞ্চিত করেনি।
জীবনে কখনো বিদ্যালয়ে চৌকাঠ ডিঙাতে পারেনি। রিকশা চালাত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। যখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পারেটিভ লিটরেচর বিভাগের জার্নাল-ভলিউম নাম্বার ৪৬/২০০৮-২০০৯ এর ১২৫ থেকে ১৩৭-১২ পৃষ্ঠা জুড়ে তার জীবন এবং সাহিত্য কৃতি নিয়ে আলোচনা থাকে, সে তো নিজেকে ধন্য ভাবতেই পারে। বহু সব স্বনামধন্য সম্মানীয় মানুষ যখন তাদের শক্তিশালী কলমে তার কথা লেখেন–যুগান্তর, রাজার বা এ জাত বর্তমান, আনন্দবাজার, প্রতিদিন, আজকাল, ই.পি.ডব্লু, কথাদেশ, নতুন খবর, দিনকাল, দি হিন্দু, স্টেটসম্যান, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, মেইনস্টীম আরেক রকম, দৈনিক জাগরণ, যুগশঙ্খ, হিন্দুস্থান টাইমস এই সব পত্রিকায় তার নাম পরিচয়, প্রকাশিত হয়, দূরদর্শনের জনপ্রিয় প্রোগ্রাম “খাসখবর”, আকাশ বাংলায় “সাধারণ অসাধারণ” “খোঁজখবর” প্রোগ্রাম, তারা নিউজের “তারার নজর” ২৪ ঘন্টা, ইটিভির সংবাদে যখন তাকে দেখানো হয় RSTV চ্যানেল তথ্য চিত্র বানায় সে ভাবতেই পারে–জীবন সার্থক।
একবার হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রধান শ্রদ্ধেয়া টুটুন দিদির (টুটুন মুখার্জী) আমন্ত্রণে চলেছি হায়দ্রাবাদ। স্টেশন থেকে চলেছি এক অটো রিকশায়। বলি তাকে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায় নিয়ে যেতে। অটো চালক পড়াশোনা জানা! সে দেশ বিদেশের অনেক খবর রাখে। আমি কলকাতা থেকে গেছি শুনে জিজ্ঞাসা করে কলকাতার যে রিকশা চালক, কোনদিন কোন স্কুলে যায়নি, এখন এক লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তাকে আমি চিনি কিনা!
বলেছিলাম-চিনি। এবং একথা একটুও ভুল নয়, যে তাকে আমার মত আর কেউ চেনেনা। আমি চিনি অনেক বেশি। সেই নিয়েই এই আমি। আমার আমি।
.
অধুনা বিলুপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের বরিশাল জেলার পিরিচপুরের সন্নিকটে তুরুকখালি নামক একস্থানে হতদরিদ্র এক দলিত পরিবারে আমার জন্ম। সে দিনটা ছিল তাপদগ্ধ বৈশাখ মাসের কোন এক রবিবার।
সেই রাতে কালবৈশাখির প্রবল ঝড় উঠেছিল। যে ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল দরিদ্র মানুষের অনেকগুলো কুড়ে ঘরের খড়ের চাল। ভেঙে পড়েছিল বড় বড় গাছের মোটা মোটা ডাল। মানুষ কাঁদছিল, হাহাকার করছিল, বাজ পড়বার বিকট শব্দে ভীত হয়ে পড়েছিল। মা আমাকে বুকের আড়াল দিয়ে রক্ষা করছিলেন সেই ক্রুদ্ধ প্রকৃতির রোষানল থেকে।