শীত গ্রীষ্ম বর্ষা প্রায় দুশো লোকের রান্না করতে হয় আমাকে। রান্না, বাসন মাজা, সবজি কাটা, পরিবেশন, টেবিল মোছা, তারপর আবার গোডাউন থেকে মালপত্র মেপে মেপে বের করা, সব করতে হয় মাত্র দুজনে। বাইরে যখন বিয়াল্লিশ ডিগ্রি গরম, টিনের ছাউনি দেওয়া রান্না ঘরে, দশ থেকে বারো ঘণ্টা চারখানা উনুনের সামনে রুটি সেঁকার মত শরীর সেঁকার পর যখন আমি লিখতে বসি, আমার কলমের আগায় যে তীব্র তীক্ষ্ণ শব্দ উঠে আসে–যা আমার লেখার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য–নরম আরাম কোমল জীবন পেলে সেই শব্দ তো আমার কলমে আসতো না। শাসন শোষণ অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে ভাষায় আক্রমণ করি, তখন আর হয়তো তা করতে পারতাম না। আমিও হয়তো তখন সধী লেখকদের মত চাঁদ তারা ফুল জোছনা পাহাড় ঝরনা–এই সব নিয়ে লিখতাম। উনি আমার সেই ক্ষতিটা করতে চাননি। আমাকে যে খুবই ভালোবাসতেন। মায়ের মতো ভালোবাসতেন। আর চাননি বলেই আমাকে আমার অবস্থানে থাকতে দিয়েছেন। নাড়িয়ে দেননি আমাকে আমার মাটি শিকড়–রস রসদের শক্তিকেন্দ্র থেকে। উনি সেটা পারতেন। ওনার একটা ফোনে আমার কর্মস্থলটা বদলে দিতে পারতেন। অনেককে দিয়েছেন। খালি আমার বেলা বাদ। কারণ উনি আমাকে আর কিছু নয়–লেখক বানাতে চেয়েছেন। স্বাধীন স্বনির্ভর আর সাহসী লেখক। এই কারণে আমি ওনার প্রতি ভীষণ ভীষণ রকম কৃতজ্ঞ। রোগা হোক, ছোটো আর দুর্বল হোক–দাঁড়িয়ে আছি নিজের পায়ে, কোনও খুঁটি লাঠির ভরকেন্দ্র ছাড়াই। খুঁটি লাঠির সহায়তায় দাঁড়ানো মানুষের অবলম্বনটা কোনও কারণে সরে গেলে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। আমার সে ভয় নেই। আর খুব বেশি উঁচুতে তো উঠিনি, পড়লে খুব একটা বেশি ব্যাথাও লাগবে না। এইখানেই মহাশ্বেতাদেবী অন্যদের চেয়ে অনন্য, অসাধারণ, দূরদর্শী, আর অন্যদের চেয়ে ভীষণ রকম আলাদা। এই কারণেই তার পায়ে শ্রদ্ধায় আমার মাথা আপনা-আপনি নুয়ে আসে।