সেদিন আমার লেখা ছাপাবার কোনও উদ্যোগ নেননি বলে মহাশ্বেতাদেবীর উপর মনে মনে খানিকটা অভিমান করেছিলাম। কষ্ট দুঃখ যে পেয়েছিলাম খানিকটা–সেটা আজ আর লুকাব না। অভিমানেই বালিগঞ্জে ওনার বাড়িতে যাওয়া আসা খুব কমিয়ে দিয়েছিলাম। তবে মহাশ্বেতা দেবীর বাড়ি না গেলেও ওনার ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যের বাড়ি যাওয়া আসা ছিল। কারণ তার ছেলে বাউকে আমি রিকশা করে ইস্কুলে পৌঁছে দিতাম। ওনাদের কাছে পাঁচশো টাকা ধার করে আমি একটা রিকশা কিনেছিলাম। বাউকে দুবেলা বহন করার ভাড়া বাবদ মাসে মাসে পঞ্চাশটাকা করে শোধ হয়ে যেতো। এক বছরে সে টাকা পরিশোধ হয়ে যায়। এরপর তো আমি মধ্যপ্রদেশ চলে যাই। ওখানে গিয়ে যোগাযোগ ঘটে ছত্তিশগড়ের শ্রমিক নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সাথে। শঙ্কর গুহ নিয়োগীর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় লেখার সাথে তেমন একটা সম্পর্ক আর থাকে না। বলতে গেলে মহাশ্বেতাদেবীর সাথেও প্রায় সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ফিরি ৯৭ সালে। আততায়ীর গুলিতে শঙ্কর গুহ নিয়োগী নিহত হবার পর। উনি বেঁচে থাকলে আর আমার হয়তো বাঙলায় আসাই হত না, লেখালেখিও আর হত না। হয়তো আমার পরিচিতি হতো একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। উনি না থাকার কারণেই আমাকে ফিরে আসতে হয়। এর মাঝে কেটে গেছে আট বছর। এখানে তখন অন্য কিছু করার মতো নেই বলে আবার নতুন করে লেখালেখিটা শুরু করি। সেই সময় আমাকে সব চেয়ে বেশি সহযোগিতা দেন মীনাক্ষী মুখার্জী। উনিই আমার একটা লেখা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে EPW পত্রিকায় প্রকাশ করার ফলে বাংলা তথা সারা ভারতের লোক আমার বিষয়ে জানতে পারে। এই সময় মনোরঞ্জন ব্যাপারী নামের একটা চরিত্র বানিয়ে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত হিন্দি সাহিত্যিক অলকা সারাওগী একটা উপন্যাসও লিখে ফেলেছেন। তবে তার আগেই আমি লেখার জগতে নিজের জন্য একটা ছোট্ট জায়গা বানিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম।
এরপর মহাশ্বেতাদেবীর সাথে আবার যোগাযোগ ঘটে ২০০০ সাল নাগাদ–আমার ফিরে আসার তিন বছর পরে। এই সময় আমার বেশ কয়েকটি লেখা বর্তিকায় প্রকাশ পায়। সেই থেকে ওনার সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ ঘটে যা শেষদিন পর্যন্ত ছিল। দেখার ব্যাপার–১৯৮১ থেকে ২০১৬ মাঝের কয়েক বছর বাদ দিয়ে বাকি সবটা সময় আমি ওনার কাছে কাছেই ছিলাম। প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমি ওনার কাছে যেতাম। এতো দীর্ঘ সময়ে সেই যুগান্তর থেকে শুরু করে বর্তমান সহ অনেক পত্রিকায় উনি অনেক প্রতিবেদন লিখছেন। কিন্তু উনি রিকশাচালক লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী বিষয়ে কোথাও এক লাইনও লেখেননি। আপনাদের অনেকের মনে আছে যে উনি মারা যাবার মাত্র অল্প কয়েক দিন আগে ২০১৪ সালে এই সময় পত্রিকায় প্রায় গোটা পাতা জুড়ে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উদীয়মান, তরুণ, নবীন, সম্ভাবনাময়, লেখকদের নিয়ে। সেই ৮১ সালে আমরা যারা এক সাথে লেখা শুরু করেছি–অনেকের কথাই সেই লেখায় ছিল। এমনকি–জয় ভদ্র তারও নামে সুলেখক সম্ভাবনাময় লেখা ছিল। ছিলো না শুধু আমার নামে এক লাইন। চাইলে তিনি নিশ্চয় লিখতে পারতেন কারণ আমি তো ততোদিনে বাংলা আকাদেমি পুরষ্কার পেয়ে গেছি। পেয়ে গেছি ২৪ ঘণ্টা অনন্য সম্মান। আমার কথা কোথাও লেখেননি আবার কোনো পত্রিকা সম্পাদককেও কোনো দিন বলেননি আমার কোনো একটা লেখা ছাপাবার জন্য। কোনো প্রকাশককেও কোনোদিন বলেননি আমার কোনও একটা বই প্রকাশ করার জন্য। উনি বলেছিলেন আমার ছেলেকে একটা চাকরি পাইয়ে দেবেন। বলেছিলেন আমি যেখানে ২০০ জন লোকের রান্নার কাজ করি আর লেখার জন্য মোটে সময় পাইনা–বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে বলে আমাকে যাতে কোনও হালকা কাজে বদলি করে দেয় তার ব্যবস্থা করে দেবেন। সেটা উনি পারতেন কারণ মমতা ব্যানার্জি ওনাকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করে। উনি বললে সে কিছুতে না করতে পারত না। তবে এই সব বলেছিলেন বটে তিনি আমাকেও কিন্তু কোনওটাই করেননি।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় মহাশ্বেতাদেবী কঠিন কঠোর নির্দয়। আমারও আগে এই রকম মনে হতো। কিন্তু এখন আর তা মনে হয় না। আসলে উনি অনেক দূরের কথা ভেবেই আমার মঙ্গলের জন্য কিছু করেননি। একজন অভিযাত্রী যে হিমালয়ের শিখর ছুঁতে চায়, সে যখন এক এক পা আগাবার জন্য কঠিন পরিশ্রম করে, এক একটা পা রাখার জন্য তাকে ছেনী হাতুড়ি গাইতি চালিয়ে বরফ পাথর কেটে পা রাখার জায়গা বানিয়ে নিতে হয়, তারপর যখন সে হিমালয়ের শীর্ষ ছোঁয়, তার যে আনন্দ, আর যাকে হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সিঁড়ি ঝুলিয়ে পাহাড় চূড়ায় নামিয়ে দেওয়া হয়, তার যে আনন্দ, দুটো কোনও দিন এক হতে পারে না। নিজের চেষ্টায় পায়ে হেঁটে ওঠা ওই মানুষটাকে সবাই স্বীকৃতি দেবে একজন সফল অভিযাত্রী বলে, কিন্তু যে সিঁড়ি বেয়ে নামবে তাকে তো কেউ সেই সম্মান দেখাবে না। কেউ তার নামে জয়ধ্বনি দেবে না।
উনি আমাকে ভালোবাসতেন–খুবই ভালোবাসতেন। সন্তানসম স্নেহ করতেন। আমাকে নিয়ে অনেক দুরের ভাবনা ভেবে রেখেছিলেন তিনি। জানতেন আমার খুবই কষ্ট হবে তবু চেয়েছেন সবাই আমার নামে জয় জয় বলুক। চেয়েছেন, যত কঠোর কঠিন হোক–আমার চলার পথ যেন নিজেই আমি তৈরি করে নিই। কারও সহযোগ যেন আমার জীবনের সাথে জোঁক এটুলি পোকার মত সেঁটে না যায়। যেন ‘কৃতজ্ঞ’ শব্দটার সামনে আমাকে আজীবন হাঁটু মুড়ে মাথা হেঁট করে বসে থাকতে না হয়। যেন আমি স্বাধীন স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারি। ভাই মনকে দুর্বল হতে দেননি। মনের মাতৃস্নেহ মনেই দমন করে রেখেছেন। তাই পারলেও আমার জন্য কিছু করেননি। এই বই-এর ভূমিকাতে রয়েছে ওনার সেই মনোভাবের চিহ্ন। লিখেছেন তিনি—’মনোরঞ্জন ব্যাপারী একেবারে স্বপরিচয়ে স্বীকৃতি পেতে চান’। বলেননি তিনি যে—’আমি চাই সে স্বপরিচয়ে সমাজে স্বীকৃতি পাক।’