আমার একটা বদ অভ্যাস–আমি যেটা একবার ধরি তার শেষ পরিনতি না দেখে কিছুতেই থামতে পারি না। এটা আমার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। ভাল খারাপ যেকোন কাজ–একদম ছোট্ট তুচ্ছ নগন্য থেকে শুরু করে একেবারে চরম সীমা পর্যন্ত পৌঁছে–তার সব সার নির্যাস নিঙরে পরখ করে তারপরই থামতে পেরেছি। যখন মদ খেতাম ~~ একেবারে গলা পর্যন্ত খেয়ে দেখেছি ওতে কি মজা। যখন বুঝলাম কোন মজা নেই, শুধু পয়সার শ্রাদ্ধ মানুষের নিন্দা মন্দ অবজ্ঞা অপমান, এখানে ওখানে পড়ে থাকা। সেই যে থামলাম একেবারে থেমেই গেলাম। অপরাধ জীবনে অনুপ্রবেশ–যেটা একটা সামান্য অতিতুচ্ছ পাউরুটি চুরি থেকে শুরু–তারপর একেবারে সেই সীমায় গিয়ে থেমেছি–যার এক ইঞ্চি দূরেই লাশ কাটা টেবিল, ফাঁসীর দড়ি।
বই পড়ার বেলাও আমার ওই একই অভ্যাস। কোকশাস্ত্র থেকে কালিদাস, মপাশা থেকে মহাভারত, রবিবারের খবরের কাগজ থেকে রবীন্দ্রনাথ, যা নাগালে পাই বাছ বিচার না করেই সব গোগ্রাসে গিলি। পত্রিকা, হস্তরেখা, বিজ্ঞান, লতাপাতার গুন, খনার বচন, গোপাল ভাড়, কোন কিছুতে অরুচি নেই। সব কিছুই আমার খাদ্য।
এখন লিখতে এসেও আমার সেই রোগ চাগাড় দিল। এর শেষ পর্যন্ত গিয়ে দেখতে হবে আর কি কি তলানিতে পড়ে আছে। তবে সেই বর্তিকা থেকে যে যাত্রা শুরু করেছিলাম–অক্সফোর্ডের বই, বারাসত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের জার্নাল, পাব্লিক সার্ভিস কমিশনের প্রশ্নপত্র আর বহু কিছুতে আমার লেখা জায়গা করে নেবার পরেও বুঝতে পারছি না আর কতটা গেলে তলানিটা দেখে নিতে পারব। আমার তো মনে হয় চুড়ান্ত পর্যন্ত করতে পেরেছি। যতটুকু আমার ক্ষমতার মধ্যে কুলায়–সেটা করা হয়ে গেছে। নিরক্ষরতা থেকে স্বাক্ষর, আর তারপর লিখতে লিখতে বাংলা আকাদেমি পুরস্কার, ২৪ ঘন্টা অনন্য সম্মান। সাহিত্য জগতের দুটো বড়ো পুরষ্কার পাবার পর এখন কী বলতে পারি না, সবটা দেখা হয়ে গেছে। আর আমার দেখার মতো তেমন কিছু নেই। দেখাবার মতোও আর কিছু বাকি নেই। এবার বোধহয় থেমে যাওয়া চলে। থেমে গেলে বিরাট কিছু হানি হবার নয়। এমনিতে চেঁকি চন্দন কাঠের হলেও তার ভাগ্যে লাথিই লেখা থাকে। আমি লেখা লেখির জগতে যে হনুই হই না কেন, মুটে মজুর বাপের ছেলে–আমাকে সারাজীবন তাই করেই চাল ডাল জোগাড় করতে হবে। তাহলে আর ওই লেখা ফেকা করে আর কী হবে।
তবে এই যাত্রাটা খুব একটা সহজ ছিল না। সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক, আর্থিক অভাব অনটন, এমন বহু বাধার পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আমার চলার পথের উপর। সে সব আমার আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় লেখা আছে, তাই আর এখানে লিখছি না। আমি বরং এখানে পৌঁছাবার পথের কথা বলি। যে পথের উপর আমাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন মহান সাহিত্যিক মহাশ্বেতাদেবী। একটা নগণ্য জঘন্য ঘৃণিত জীবন, রাস্তার কুকুরের চেয়েও অধম। রেল স্টেশন ফুটপাতে শুয়ে থাকলে যাকে বিনা কারণে পুলিশ ডাণ্ডা মেরে তুলে নিয়ে যায়। লাথি মেরে দেয় বিরক্ত পাবলিক। মানুষের সমাজে যার কানাকড়িও মূল্য নেই। কাল পর্যন্ত আমি ছিলাম সেই প্রাণী। মানুষ যাকে অপমান অসম্মান অনাহার উপবাস ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। একটা লেখা ছাপা হবার পর দেখলাম সেই মানুষের কাছে আমি যেন অনেকটা মূল্যবান হয়ে গেছি। তারা আমাকে খুঁজে খুঁজে দেখা করতে আসছে, বেশ খানিকটা সমীহ দিচ্ছে। তাই মাথা খারাপ হয়ে গেল আমার। মনের মধ্যে পাগলা হাতি দাপাদাপি শুরু করে দিল। একটা লেখায় যদি এত হৈ চৈ, দশটা বিশটা লেখা ছাপা হলে তখন কী হবে। নিশ্চয় মানব সমাজে আমি পেয়ে যাব একটা আদরনীয় স্থান।
কে যেন বলেছেন লেখক হচ্ছেন একটা গোরুর মতো জীব। সে খাবে যা সব চেয়ে নিকৃষ্ট সেই ঘাস, আর দেবে যা সব চেয়ে উৎকৃষ্ট সেই দুধ। জীবন আমাকে ঠেলে গুতিয়ে এমন বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছে। সে সব অভিজ্ঞতা ভরে পড়ে আছে সঞ্চয়ের ঝুলিতে। বই তো আমার অনেক পড়া ছিল, তাই জেনেছি আমার দেখা যে জগত তা অন্য অনেকের দেখার সুযোগ মেলেনি। তাই তারা তা নিয়ে লিখে উঠতে পারেননি। লেখবার কথা ভাবতে পারেননি। একটা বিশাল জন জীবন–অদেখা অজানা ভূখণ্ড পড়ে আছে অনেকের দৃষ্টি সীমার বাইরে। আমি সেই নিয়ে অনায়াসে তো লিখে ফেলতে পারি অনেকগুলো লেখা।
তখন তাই করলাম আমি।লিখলাম চারটে ছোটো গল্প। নিয়ে গেলাম মহাশ্বেতাদেবীর কাছে। উনি দেখলেন সেগুলো। তারপর নিরাসক্ত গলায় বললেন–বর্তিকা তো গল্পের কাগজ নয়, এতে শুধু সমীক্ষা ছাপা হয়। তুমি বরং অন্য কোথাও চেষ্টা করো। এটা সত্যি যে তখন বর্তিকায় শুধু সমীক্ষাই ছাপা হত। অন্য কোন লেখা নয়।
তবে আমি তো তখন নতুন, সাহিত্য জগতের কাউকে তেমন একটা চিনি জানি না। কোথায় কার কাছে নিয়ে গেলে লেখা ছাপা হবে আমার জানা নেই। কিন্তু লেখাগুলোর কিছু একটা না করেও তো মনে শান্তি পাচ্ছি না। শেষে ঠিকানা জোগাড় করে সেগুলো পাঠিয়ে দিলাম চারটে পত্রিকার ঠিকানায়। মনে একটা সন্দেহও ছিল। হয়তো লেখাগুলো তেমন একটা ভালো হয়নি। না হলে ওনার কাছেই তো কত পত্রিকার কত প্রকাশক সম্পাদক আসে। উনিইতো এগুলো নিজে হাতে কাউকে ছাপার জন্য দিতে পারতেন। তাই নামটা বদলে নিলাম লেখাগুলো পাঠালাম জিজীবিষা এই ছদ্মনামে। ছাপা যদি নাও হয় লজ্জায় পড়তে হবে না। দুতিন মাস পরে দেখলাম চারটে লেখাই ছাপা হয়ে গেছে চারটে পত্রিকায়। এতে মনে ভীষণ জোর আর আত্মবিশ্বাস এলো। পাবব–আমিও পারব। কেউ পাশে পিছনে না থাকলেও নিজের লড়াই নিজে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব আমি।