এটায় আমার তেমন কোনও দোষ নেই। নতুন যে-কোন-জিনিস শেখা যায় তাতে মানুষের উৎসাহ থাকে অনেক বেশি। অন্য তো অন্য–দেখা যায় যে সদ্য সাইকেল চালাতে শিখেছে, সারাক্ষণ চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই। আমার অবস্থা তো তখন সেই রকম। অনেক বেশি বয়সে পড়তে শিখেছি, অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা করে। বইয়ের পাতায় চোখ রেখে আমি পৌঁছে যেতে পারি মহাকাশের গ্রহনক্ষত্রের অনন্ত উচ্চতায়, ডুব দিতে পারি মহাসমুদ্রে বিস্ময়কর অতল গভীরে। নিখরচায় নির্ভয়ে ভ্রমণ করে আসতে পারি শ্বাপদ সঙ্কুল আফ্রিকার গহীন অরণ্যে। অনায়াসে চড়ে যেতে পারি হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়। বই আমাকে দেখায় আমার না দেখা না জানা না চেনা এক অচিন ভুবন। তাই সারাক্ষণ বই পড়ি। মদের চেয়ে মারাত্মক নেশা–বই-এর নেশা। সেই নেশায় কুঁদ হয়ে বসে থাকি।
তখন মনে হয় বেলা দুটো বাজে। আমাদের রিকশা লাইনের কাছে জ্যোতিষ রায় কলেজ সে সময় ছুটি হয়েছে। সব শিক্ষক শিক্ষিকারা যাচ্ছেন বাড়ির পথে। সেই সময় আমার রিকশার সামনে এসে দাঁড়ালেন উনি। বললেন–যাবে চল। আমি রিকশায় তুলেছিলাম সেই প্যাসেঞ্জর। সেই জুন মাসের আগুন জ্বলা দুপুর–বুডবুডে করে করে ফুটতে থাকা পিচ রাস্তার উপর দিয়ে গড়িয়ে চলা রিকশার চাকা।–আমি জানতাম না, কেউ জানত না, সেদিন সেই চাকা যেন ঘুরছিল আমার ভাগ্যের চাকা হয়ে।
যদি সেদিন ওই প্যাসেঞ্জার অন্য কেউ নিয়ে চলে যেত–আমি চলে যেতাম অজ্ঞাত, অন্ধকার, অপরিচিতির কোন গোপন গহ্বরে। কেউ জানতো না আমার কথা। জীবনের যা সঞ্চয় আজ আমার হাত ধরে আমাকে এত দূর পথ হাঁটিয়ে নিয়ে এল, সব পচে গলে মাটি হয়ে যেত। কত লক্ষ লক্ষ মন সোনা তো মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে, কে তার খবর রাখে? মানুষ জানে, কদর করে দাম দেয় সেইটুকুর-যা অলঙ্কার হতে পেরেছে। উঠতে পেরেছে শ্রীঅঙ্গে।
আমার সেই প্যাসেঞ্জার–আমি ওনাকে চিনতাম না শুধু জানতাম উনি একজন শিক্ষিকা। তাই আমি কদিন আগে একটা বই থেকে পাওয়া একটা শব্দের মানে–যা আমার অজানা–তা জানতে চেয়ে বসেছিলাম তার কাছে–দিদি, জিজীবিষা শব্দের মানে কি?
এটা আমার জীবনে একটা অলৌকিক অবিশ্বাস্য অত্যাশ্চর্য ঘটনা। যেমন ঘটনা সেই এক জনের সামনে আপেল ছিঁড়ে পড়বার মত ব্যাপার স্যাপার আর কি। আপেলটা না পড়লে তার কি এত বড় বিজ্ঞানী হওয়া কোনদিন সম্ভব হতো? আপেল আগেও পড়েছে পরেও পড়বে। কেউ কেউ তো সে আপেল ছুলে খেতে খেতে চলে গেছে নিজের কাজে। তার চিন্তা চেতনায় ওটা কোনো আলোড়ন তুলতে পারেনি। কিন্তু সেদিনের সেই পতন ছিল এক বিজ্ঞানীর জীবনের জন্মলগ্নের এক মহান ঘটনা। তেমনই–আমার রিকশায় বহু মানুষ উঠেছেন, সবাইকে তো চেনবার সুযোগ হয়নি। হতে পারে তার মধ্যে কবি লেখক প্রকাশক সাংবাদিক, এমন ধরনের অনেক মানুষ ছিল। মহাশ্বেতা দেবীও তার জীবনে বহুবার বহু রিকশায় চেপেছেন, রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে চলেও গেছেন নিজের পথে। বহু সাধারণ মানুষের লেখাও তিনি উদ্যোগ নিয়ে ছেপেছেন তাঁর বর্তিকায়। কেননা তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল একটা নতুন ধরনের পত্রিকা চালানো। সময়ের স্রোতে তারা কে কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ তার আর কোনও খবর জানেনা। আমার পরে আর এক রিকশাঅলার লেখাও বর্তিকায় ছাপা হয়। সে লেখকের আর কোনদিন কোনও লেখা প্রকাশিত হতে পারেনি। তাই আমার সাথে মহাশ্বেতাদেবীর সাক্ষাৎ সেই দিক থেকে একটা বিরাট বিশাল ঘটনা। আজ আমার যা কিছু খ্যাতি যশ প্রাপ্তি সব সেই সেদিনের পরিনতি। ওনার সাথে দেখা না হলে এটা হওয়া আমার পক্ষে হয়ত কোনও দিন সম্ভবই হত না। যেমন আপেল না পড়লে নিউটন–নিউটনই হতে পারতেন না। অন্যের কথা জানিনা আমি, ওনার সাথে দেখা না হলে আসতেই পারতাম না এই লাইনে।
আমি সে সময় রামায়নে বর্ণিত সেই দন্ডকারন্যের বনে থাকতাম। একদিন আমি আর আমার ভাই দুজনে যাচ্ছি জঙ্গলে কাঠ কাটতে। আমাদের দুজনেরই বিড়ি খাবার নেশা। বিড়ি তো নিয়েছি সাথে কিন্তু বিড়ি খেতে হলে আগুন লাগে সে কোথায় পাবো? তাই একটা ঘুঁটে পুড়িয়ে সাথে নিয়ে নিলাম। বন পথ ধরে আমরা যখন যাচ্ছি, খেয়াল করিনি যে একটা ছোটো টুকরো ছুটে থেকে ভেঙ্গে নিচে পড়ে গেল। ওটা যে ওখানে একটা মারাত্মক ব্যাপার তা আমরা কি করে জানবো? আমাদের বাঙলায় তো এমন কতো বিড়ি সিগারেট আগুন সহ এদিক সেদিক ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। আমরা তো এখানে নতুন। কিছু জানি বুঝি না। তো আমরা যখন ঘন্টা দুয়েক পরে কাঠের বোঝা মাথায় করে ফিরে আসছি–দেখি বিশাল একটা এলাকা জুড়ে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। আর একটু এগিয়ে দেখি–যেখানে আমাদের ভাঙ্গা টুকরোটা পড়ে ছিল সেখান থেকে একটা আগুন এগিয়ে যাবার সরু রেখা। জুন মাসের শুকনো সময়–সে যত সামনে এগিয়েছে। তত শুকনো ঘাস নাগালে পেয়েছে তাই ক্রমে রেখা চওড়া হয়ে গেছে। যত সামনে এগিয়েছে তত ঘাস পাতা কাঠ নাগালে পেয়েছে। এই ভাবে ক্রমে শক্তি বৃদ্ধি করেছে সে। আর এক সময় পুরো জঙ্গলটা গ্রাস করে নিয়েছে। ওই সামান্য আগুন খসে যাওয়ার পরিনতি কি আমরা যেমন জানতাম না, আমার মনে হয় যেদিন আমাকে প্রথম বর্তিকায় লেখার কথা বলেছিলেন–মহাশ্বেতাদেবীও হয়ত কল্পনা করতে পারেন নি যে একদিন আমি আজকের এই জায়গায় আসতে পারব। দাবানল হয়ে যাব। বহু বছর পরে আবার যখন দেখা হয় একদিন–সেদিন তিনি অবাক বিস্ময়ে বলেছিলেন সেই কথাই–তুই যে এত লম্বা রেসের ঘোড়া আমি আগে জানতাম না।