তবে আমি সবদিন মেনেছি মানুষকে। মানুষ মানুষ মানুষ, একমাত্র মানুষই আমার উপাস্য আমার সমস্ত বিনম্র প্রনাম বর্ষিত হয়েছে মানব দেবতারই শ্রীপাদপদ্মে। মন্দির মসজিদ গির্জা তীর্থস্থানে কোন দিন যাইনি আমি। কালীঘাট থেকে কামাখ্যা–গয়া থেকে গঙ্গাসাগর, ঘুরেছি তো অনেক জায়গায়। কিন্তু কোথাও ভক্তিতে গদগদ হতে পারিনি। যুক্তির কষ্ঠী পাথরে সব মূর্তি আমার কাছে বাচ্চা ভোলানো পুতুল হয়ে রয়ে গেছে। যত সব নাঙ্গাবাবা সাধু সন্ন্যাসী প্রতিপন্ন হয়েছে অলস কর্মভীরু ঠগ চোর জোচ্চোর বলে। তাই আমি ছুটে গেছি মানুষের কাছে। ছুটে গেছি আমার দেবী–মহাশ্বেতাদেবীর কাছে। তার নিবাস আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে হিন্দুর অমরনাথ, মুসলমানের মক্কা মদীনার মর্যাদায়। মানবী মহাশ্বেতাকে বসিয়েছি বিদ্যার দেবী সরস্বতীর মহান আসনে। আর সেই দেবীর কাছে বসে “একলব্য” একাগ্রতায় পাঠ নিয়েছি মহাশব্দ জিজীবিষার–। জিজীবিষার মানে বেঁচে থাকার ইচ্ছা। আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকার নামই–জিজীবিষা। মরার ভয়ে নুয়ে বেঁকে ঘাড় গুঁজে বাঁচা নয়, বীরদর্পে এগিয়ে আসা মৃত্যুর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে প্রতিহত করা–তার নামই জিজীবিষা।
সবাই জানেন, নতুন করে বলার কিছু নেই। আমাকে নিয়ে দেশ বিদেশের নামী দামী পত্র পত্রিকায় শতশত বার লেখা হয়েছে, টেলিভিশনে বারবার দেখানো হয়েছে। লক্ষ লোক আমার আত্মজীবনী পড়েছে। তার ফলে সবাই প্রায় জানে যে আমি কোনো দিন কোনো ইস্কুলে যেতে পারিনি। বাবার সে ক্ষমতা ছিল না যে এক মুঠো খেতে দেয়, একটা বই দিয়ে ইস্কুলে পাঠায়। বাল্যকাল কেটেছে আমার গোরু ছাগল চড়িয়ে, চায়ের দোকানে হোটেলে গেলাস থালা ধুয়ে। একটু বড় হয়ে মুটেমজুর রিকশাঅলা শতেক রকমের শ্রমের কাজ, ডোম সুইপার নাইটগার্ড ট্রাকের খালাসী–আরও কত কি। এই যে জীবন–এ কোন মহৎ জীবন হতে পারে না। একটা পাহাড়ের মাথায় বরফ জমে, সেই জল নালা নদী দিয়ে পৌঁছে যায় সমুদ্রে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু যদি সেই নালা নদীর সামনে একটা বাঁধ পড়ে যায়, সে আর সাগরে যেতে পারেনা। তখন সে দুই পাড়কে প্লাবিত করে দেয়। জন জীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এর জন্য সে দায়ী নয়। দায়ী সেই বাঁধ। বাঁধ ভেঙ্গে দাও–জল চলে যাবে তার আপন বেগে নিজের পথ ধরে। বিপদ কেটে যাবে। বাঁধ থাকলে বাধা প্রাপ্ত জলচ্ছাস বন্যা ডাকবে। রাজপথ জনপদ ভাসাবে ~ ঘর বাড়ি ডোবাবে। আমি সহজ সরল স্বাভাবিক ভাবে বহে যেতে পারিনি–জীবনের চলার পথে নানা ঘাটে পড়ে গেছি নানান নির্দয় বাধার সামনে। প্রতি মুহূর্তে প্রতিহত হয়েছে আমার চলাচল। ফলে যা হয় উল্টোপাল্টা দিকে বয়ে গেছে আমার জীবন। বইতে বইতে একদিন দেখলাম পৌঁছে গেছি জেলখানার কালো কুঠুরিতে।
সেইখানেই একজন অসাধারণ মানুষের দেখা পেয়েছিলাম। বাইরে তো পাইনি–হয়তো এমন মানুষেরা বাইরে থাকতে পারে না। ভালো মানুষের শত্রুরা তাদের ধরে জেলখানায় ভরে দেয়। তাই এইসব মানুষকে খুঁজে পেতে হলে জেলখানায় আসতে হয়। সেখানেই সেই মহান শিক্ষকের সাক্ষাৎ পাই, যিনি আমাকে অসীম ধৈর্য সহকারে জেলখানার মাটিতে কাঠির আঁচড় দিয়ে শেখান বাংলা বর্ণমালার সবকটা অক্ষর। একদিন তিনি আমাকে জেলখানার জানালা দিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরির কার্নিশে লতপত করতে থাকা বিঘৎ খানেক একটা ছোট্ট বটের চারা দেখিয়ে বলেছিলেন–‘ওই নিরেট সিমেন্টের উপর যেখানে কোনও রসকষ নেই, মাটি নেই জল নেই, অত ছোট্ট চারাটা এত প্রতিকূলতার মধ্যে বেঁচে আছে কি করে জানিস? বেঁচে আছে, কারণ ও মরতে চায় না। বেঁচে থাকতে চায়। আর যে বাঁচতে চায় কারও ক্ষমতা নেই তাকে মেরে ফেলবার বেঁচে থাকার ইচ্ছা, এর নামই তো জিজীবিষ।
আপনারা তো সে গল্প আগেই পড়ে নিয়েছেন যে কিভাবে আমার সাথে মহাশ্বেতোদেবীর সাক্ষাৎ হয়। সেটা ছিল ১৯৮১ সালের জুন মাসের এক তাপদগ্ধ শনিবার। জেল থেকে বের হয়ে আমি তখন রিকশা চালাই। আমরা সেই মহান দেশের নাগরিক, যেখানে একজন নিরীহ নির্বল ধনহীন মানুষ পথে পড়ে না খেয়ে মরে গেলেও কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। রাস্তায় পড়ে রোদে শরীর পোড়ালে, বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হলেও কেউ মাথার উপর একটা ছাউনি এনে দেবে না। রোগে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের সামনে বসে কাতরালেও কেউ দেবে না এক ফোঁটা ওষুধ। প্রবল শীতে কুঁকড়ে কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ফুটপাতে শুয়ে থাকলেও কেউ মমতা করে এসে একটা কম্বল ঢাকা দেবে না। অথচ ভাণ্ডারে অচেল আছে। সরকার চাইলেই দিতে পারে। সে দেবে কখন? যখন সে কারও পেটে, গলার নলিতে চাকুর পোঁচ মেরে জেলখানায় চলে যাবে। তার আগে একদম নয়। সে তখন রাজ অতিথি–তখন সব পাবে সে–যেটুকু আগে পেলে আর জেলে তার আসবার কোনও দরকারই পড়ত না। তখন খেতে না চাইলে সেপাই এসে নাকে নল ঢুকিয়ে জোর করে পেটের মধ্যে খাবার ঢুকিয়ে দেবে।
আমার কপালে যতদিন সে সুখ ছিল, জেলে ছিলাম। একদিন সুখ ফুরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে জেল থেকে বাইরে আসতে হল। তখন তো আর কেউ গরম ভাতের থালা নিয়ে আমার জন্য বসে নেই। বাধ্য হয়ে তাই আমি পেটের প্রয়োজনে রিকশা চালাতে আরম্ভ করলাম। আর সেদিন রিকশায় সওয়ারি পাবার আশায় বসেছিলাম বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজের সামনে। ওখানে রিকশার উপর বসেই একটা বই পড়ছিলাম। নতুন নয়, সব দিনই আমি এই করি। যখনই সময় পাই বই পড়ি।