মানুষ বিপন্ন মানুষ এখন বড়োই অসহায়। তাদের পাশে পিছনে দরদী সাহসী লড়াকু মানুষের বড়ো অভাব। এই রকম এক নির্বান্ধব সময়ে মহাশ্বেতাদেবীর বড়ো দরকার ছিল। দরকার ছিল তার সচেতন সাহসী শক্তিশালী ধারালো তলোয়ারের মতো সচল লেখনীর। সুর্য সমান অনল অমল অনির্বাণ ক্রোধে, অসম সাহসে–অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যিনি মসিযুদ্ধ জারি রেখেছিলেন। কোনও প্রলোভনে বিকিয়ে যাননি, কোনও ভয়ের সামনে নতজানু হননি। খালি পা খালি গা খালি পেট–যে মানুষ, সেই নিরন্ন নির্ধন মানুষের স্বার্থে আজীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন। সত্তর দশকের ভয়ংকর দিন থেকে শুরু করে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নেতাই–বার বার গর্জে উঠেছেন তিনি। তার অগ্নিবর্ষী ক্রুদ্ধ কলম কামানের নলের মতো গোলার পর গোলা দেগেছে। নরখাদক, হিংস্র–মানব সভ্যতার চরম অনিষ্টকারীদের দুর্ভেদ্য দুর্গ লক্ষ্য করে।
নকশাল বাড়ির সাত কৃষক রমণীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যারা একদিন বীরদর্পে শুরু করেছিল পদযাত্রা, সে যাত্রা শেষ হয়েছিল নেতাইয়ে এসে–আবার সাত রমণীর হত্যাকাণ্ডের পরে। দাম্ভিক অত্যাচারী সেই শাসকদের চলার পথে পড়ে আছে মরিচঝাঁপি সহ পঞ্চান্ন হাজার মানুষের ছিন্নভিন্ন নিষ্প্রাণ দেহ। হাজারের অধিক ধর্ষিত নারীর মলিন মুখ। কেউ কোনও দিন ভাবতে পারেনি মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে কেউ তাদের সামনে তর্জনী তুলে গর্জন করে বলবে–হত্যাকারীরা হুসিয়ার। এবার তোমরা থামো। অনেক হয়েছে–আর নয়। এটাই উনি করেছিলেন। অন্য কোনও লেখক কবি সাহিত্যিক যা পারেনি। তিন দশকেরও অধিককাল বাংলার প্রতিবাদী কলম বোবা বধির অন্ধ হয়ে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল শাসক শোষকদের–পুঁজিবাদীদের প্রতিনিধিদের পদতলে কিছু নগদ প্রাপ্তির লোভে লালসায়। সেই বন্ধ্যা সময়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠতে একমাত্র উনি পেরেছিলেন।
সেটা বাংলার পক্ষে, গোটা বাঙালি জাতির পক্ষে, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের পক্ষে, বড়ো লজ্জাজনক কাল–বড়ো বেদনাদায়ক সময়। কে যেন বলেছেন–লেখক কলম দিয়ে নয়, লেখে শিরদাঁড়া দিয়ে। বাংলার ‘আগুন ওগরানো’ প্রতিবাদী কলম সে সময় বিকিয়ে দিয়েছিল নিজের শিরদাঁড়া। কুকুরের লেজের মতো বেঁকে গিয়েছিল লাল কালির সব হরফ। বিপ্লবী লেবেল আঁটা বুদ্ধিজীবীরা টাকা আনা পাই দরে ভাড়া খাটাচ্ছিল যে যার জিভ। সেই দিনে–সেই নিবীর্য নির্জীব বন্ধ্যা সময়ে–অতন্দ্র প্রহরীর মতো মানুষের পক্ষে অটল দাঁড়িয়ে ছিলেন রণাঙ্গনে–একা এক ‘কলমকা সিপাহী’ মহাশ্বেতাদেবী। নির্দয় আর ক্ষমাহীন দৃঢ়তায়–যা অন্যায় অনুচিত, যা অমানবিক–তার বিরুদ্ধে। আদিবাসী বনবাসী দলিত দরিদ্র শ্রমজীবী সংখ্যালঘু মানুষদের–ন্যায় সংগ্রামের পক্ষে।
সেদিন বাংলার শাসন ক্ষমতার দখল নেওয়া ‘হীরক রাজা’ গর্জে উঠে বলেছিল–এই চাষা ভুযোরা–তোদের জমিভূমি বাসস্থান, তোদের মন্দির মসজিদ গির্জা, তোদের হাসপাতাল ইস্কুল পুকুর, খেলার মাঠ, তাদের ফলের বাগান, ফুলের বাগিচা, তোদের শ্মশান গোরস্থান, তাদের জল বাতাস আকাশ, সব আমাকে দিয়ে দে। সব দিবি–যা তোর আছে। না দিলে আমার পুলিশ তোকে খুন করবে। আগুন দেবে তোর ঘরে। সেই আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হবে তোর শিশু সন্তানকে। তোর মা মেয়েকে গণধর্ষণ করবে। সেদিন সেই বিপন্ন মানুষের সামনে প্রতিরোধের দেওয়াল তুলে যিনি দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি এই মহাশ্বেতাদেবী।
আজ আবার আর-এক মহালড়াই আসন্ন। দিকে দিকে তারই আগমণ বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে। পালাবার পথ নেই, পরিত্রাণের কোনো উপায় আর নেই। মহা সর্বনাশ থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে পরিবার পরিজন নিয়ে মানুষকে বাঁচতে হলে–ন্যায্য অধিকার আদায় করতে হলে–দলিত দরিদ্র সংখ্যালঘু সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। রক্ত পিপাসু ঘাতকের উদ্যত অস্ত্রের সামনে আঙ্গুল তুলে বলতে হবে–খবরদার। আর আগাতে চেওনা। আর এক পা আগালে আমরা কিন্তু হত্যাকারীকে নীরব করে দেবার মহামন্ত্র ছুঁড়ে দেবো। আগ্নেয়গিরির মতো সে মন্ত্র তোমাদের ভস্মীভূত করে দেবে। বিলুপ্ত বিলীন–ইতিকথা বানিয়ে দেবে। এই দিনে আমাদের পাশে মহাশ্বেতাদেবীর অভাব বড়ো বেশি অনুভূত হবে। আর তো কেউ এমন একজনও নেই। উনি অদ্বিতীয়, এক এবং একক। ওনার ফেলে রেখে যাওয়া আসন আজ শূন্য। এই দিনে মেহনতি মানুষের ওনাকে বড়ো প্রয়োজন ছিল।
আমরা সেই ভীষণ সময়ে রণাঙ্গনে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মহাশ্বেতা দেবীর জীবন এবং কর্ম আর আগুনের বর্ণমালায় রচনা করে রেখে যাওয়া সুবিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে শক্তি আর সাহস খুঁজে নেব। অনুপ্রেরণা দেবে, আমাদের পথ প্রদর্শক হবে সেই আগুন আঁখর। বীরসা, বসাই টডু, চেট্টি মুণ্ডা, দোপদীর পাশে পিছনে হেঁটে আমরাও পৌঁছে যাব শত্রুর মুখোমুখি মহড়া নেবার জন্য। কোনও ভয়কেই আমরা ভয় পাবে না। ভয়কে ভয় পাইয়ে দেবার শিক্ষা দেবে ওই আগুনের বর্ণমালা।
মহাশ্বেতাদেবীর প্রয়াণে প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন যেমন হারিয়েছে তার এক অনমনীয় আপোষহীন লড়াকু সেনাপতিকে, আর আমি ব্যক্তিগত ভাবে হারিয়েছি–আমার সেই মাকে। যিনি প্রায় ঘৃণিত অভিশপ্ত এক আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে আমাকে সন্ধান দিয়েছেন একটা নতুন জীবনের। গভীর ভাবে বুঝিয়ে ছিলেন ‘জিজীবিষা’ শব্দের যথার্থ অর্থ। বেঁচে তো অনেক রকম ভাবেই থাকা যায়, অনেক রকম ভাবেই বাঁচে মানুষ। কিন্তু সে বাঁচা কেমন বাঁচা–যা মরার পরেই সব ফুরিয়ে যায়। নিঃশেষ হয়ে যায়। আমাকে উনি সেই জীবনের সন্ধান দিয়েছেন যে জীবনের কোনও অন্ত অবশেষ নেই, সমাপ্তি নেই। আমি সেই জীবনের তপস্যা শিখেছি ওনার কাছে বসে। ১৯৮১ থেকে ২০১৬ প্রায় ৩৬ বছর কাল সময়। এত দীর্ঘকাল ধরে বিশাল এক মহীরূহের মতো ব্যাপ্ত হয়েছিলেন তিনি আমার জীবনে। যেখানে যাই, যত দূরেই যাই সে বৃক্ষ আমাকে ছুঁয়ে থেকেছে সর্বক্ষণ। আস্তিকের মন মনন জীবনে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো। সে এমন এক বৃক্ষ, শ্রান্ত হলে যার ছায়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যায়। যে সঞ্জিবনী বৃক্ষের স্পর্শ মৃতদেহ অমৃত প্রবাহ বইয়ে দেবার মতো আশ্চর্য ক্ষমতা রাখে। আমি নাস্তিক, ঘোর নাস্তিক। জাতপাত ধর্মবর্ণ দেবদেবীআল্লাভগবান কোনও কিছুতে আমার এতটুকু আস্থা নেই। পৃথিবীতে এত অন্যায় অত্যাচার রোগ শোক অসাম্য, মানুষে মানুষে এত বিভেদ। সব সে দেখছে। সে ভদ্রলোক নাকি অসীম ক্ষমতার অধীশ্বর, এক তুড়ি মেরে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃজন করেছেন। এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে এর কোনও প্রতিকার করছে না। আর আমাকে তো কী এক আক্রোশে যেন জন্ম থেকেই না খাইয়ে রেখেছে। এমন অবস্থা রাখেনি যে একটা বই নিয়ে এক মুঠো খেয়ে ইস্কুলে যাই। যে বয়সে বাচ্চারা যায় ইস্কুলে, আমাদের পেটের দায়ে যেতে হয়েছে মানুষের ছাগল গোরু চড়াতে। পায়ে চপ্পল, গায়ে একটা জামা, মাথায় এক ফোঁটা তেল, এক কুচো সাবান–যে আমার জন্য সামান্য এইটুকু ব্যবস্থা করে রাখতে পারেনি, উল্টে কিশোরবেলায় আমি যেখানে যেখানে কাজ করেছি–ভগবানের পরম ভক্তরা আমাকে বারো চোদ্দ ঘণ্টা খাঁটিয়ে নিয়ে আমার মজুরি পর্যন্ত দেয়নি–মেরে দিয়েছে। সব তো সে দেখেছে? মানে–চোখ থাকলে তো নিশ্চয় দেখবার কথা। অন্ধ হলে আলাদা ব্যাপার। কোন বইপত্রে যখন পাওয়া যায় না যে–ভগবান অন্ধ, তার মানে সে চোখে দেখে। তাহলে সব দেখে শুনেও যে এমন কানা, সেই কানা ভগবান দিয়ে আমার কি হবে? আমি তাকে না মানলে সে আমার উপর রেগে যাবে। তো যাক না। কে বারন করছে। যা ক্ষতি সে আমার করেছে তার বেশি আর কি করবে? আমি জানি–অনেক বছর আগে একদল না খাওয়া মানুষ এক কালী মন্দিরের দরজা ভেঙ্গে জাগ্রত কালীমাতা নামে পূজিত কালীর সোনার পাতে মোড়ানো জিভ মুচড়ে ভেঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিল। সেদিন সেই জাগ্রত কালী নিজেকেই নিজে রক্ষা করতে পারেনি। সেই দেব দেবতা আমার কি ব্যাক করবে?