কাক কোকিলের মত ডাকে ওরা সেই ডাকটা নিয়ে কৌতূহলী, কাকটার জীবন যন্ত্রণা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।
লক্ষৌ দিল্লি মুম্বাই পাটনা কত জায়গা থেকে ডাক আসে। কত সমাদর করে নিয়ে যায়। অনুষ্ঠান মঞ্চ আমার বক্তব্য শুনে হাততালি দেয়, পত্র পত্রিকায় ছবি প্রতিবেদন লেখা হয়। পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তোলে, কতজন অটোগ্রাফ নেয়। অনুষ্ঠান শেষে ফিরে আসি আর কেউ আমার কোন খোঁজ খবর রাখে না। আর কী দরকার, আমাকে যেটুকু ব্যবহার করা যায় সে তো হয়ে গেছে। দেখা যাবে আবার পরের বছর।
লেখালেখির জগতে অনুপ্রবেশ পেয়ে যাবার পরে অনেক বিশিষ্ট অতি বিশিষ্ট স্বনাম ধন্য, সেক্ষেত্রে উজ্জ্বল মানুষজনের সাক্ষাৎ পেয়েছি। এনাদের সাথে পরিচিত হবার পরে যেমন হয় আর কী, আমার মনের মরা নদীতে আশার বাণ ডেকেছে। এত ক্ষমতাবান এরা, হয়তো এবার বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে। তারা তাদের থৈ থৈ দয়া কৃপার পাত্রটা থেকে দুচামচ এই অভাগার পাতে দেবে। অন্যদের কথা বাদ–যেসব নিম্নবর্ণের লোক উচ্চপদে বসে নিচের লোকেদের জন্য কেঁদে কেঁদে পত্র পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখে, যারা নিম্নবর্ণ উন্নয়ন দপ্তরে বড় বড় সরকারি চাকরিতে বহাল, কারও না কারও নেক নজর আমার দিকে পড়বে।
বড় বিচিত্র এই দেশ। অদ্ভুত এ দেশের নিয়ম কানুন। এখানে খেলোয়াড়দের জন্য রেলে সেনাবাহিনীতে ব্যাংক পোস্ট এ্যাণ্ড টেলিগ্রাফে–আরও কত বিভাগে চাকরি দেবার প্রবধান আছে। চোলাই খেয়ে মরে গেলে সরকার টাকা দেয়, মসজিদের ইমামরাও ভাতা পায়–শুধু বেচারা গরিব লেখকদের দেবার মত কিছু নেই, দেখার মত লোক নেই।
কিছু দিন আগে মরে গেলেন একা কুম্ভ বইয়ের লেখক আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত গরিব কথা শিল্পী সদানন্দ পাল। কী তার জীবন, কী ভাবে পেটে গামছা বেঁধে সাহিত্যের সেবা করে গেছেন সব লেখা আছে একা কুম্ভ বইয়ের পাতায় পাতায়।
ক্যানসার হয়েছিল তার। পয়সার অভাবে তেমন চিকিৎসাও করাতে পারেননি। অসহায় অবস্থায় তিলে তিলে মরে গেলেন।
আমি ভয় পাচ্ছি। সত্যিই আমি এখন ভীত হয়ে পড়েছি। টের পাচ্ছি পায়ে পায়ে ওই রকম একটা যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু আমাকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। দিনে দিনে হাঁটু দুটো অকেজো হয়ে আসছে–আর সে দেহের ভার বহন করতে পারছে না। হাজার মাইল পথ হেঁটে আর তার চলার শক্তি নেই। তাই ভয় পাচ্ছি। যে দিন বিছানায় শুয়ে পড়ব, গ্রাসাচ্ছদন কী করে চলবে!
তাই বড় ভয় পাচ্ছি এখন। বিছানায় শুয়ে যদি স্ত্রী পুত্রের অনাহার দেখতে হয় সে বড় কষ্টের।
আর আমার কিছু বলার বা লেখার নেই। যতটুকু পেরেছি–বলেছি। যদিও বলা অংশের চেয়ে অনেক বেশী রয়ে গেল না বলা। আমি কেন, কোন মানুষই বোধহয় জীবনে সব কথা অকপটে বলে যেতে পারে না। কিছু কথা মনের মধ্যে গোপন করে রেখে দিতেই হয়। সেই না বলতে পারা কথারা তাকে রক্তাক্ত করে।
***
২৮শে জুলাই ২০১৬ একটা বড় ভয়ংকর কঠিন সময়ে চলে গেলেন সংগ্রামী সাহিত্যিক, আদিবাসী মানুষের বড়ো প্রিয়-বড়ো আপনারজন, মারং দাই __গা___ শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করার এক আপোষহীন সেনাপতি। জীবনের এই এক চরম কঠিন নিয়ম–একে অস্বীকার করবার ক্ষমতা কারওরই নেই। জন্ম যখন হয়েছে–সব কিছুটান পিছে ফেলে, সব বাঁধন বন্ধন ছিঁড়ে ছুঁড়ে, একদিন তো সবাইকে চলে যেতেই হয়। তবে এটা নির্মম ভাবে সত্যি, যে এক একজন মানুষের চলে যাওয়ায় মানব সমাজে তার বিরাট একটা প্রভাব পড়ে, সেই মানুষটার অনুপস্থিতিতে যে বিশাল বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা আর কোনও ভাবে কোনও কিছু দিয়ে পূরণ করা যায় না। মহাশ্বেতাদেবীর বেলা এই কথাটা আরও বেশি করে সত্য।
আজ সারাদেশ জুড়ে শোনা যাচ্ছে ভয়াল ভয়ংকর একটা অশুভ শক্তির প্রবল পদধ্বনি। বীর বিক্রমে সে ধেয়ে আসছে অপ্রতিহত খেপে ওঠা বুনো শুয়োরের মতো। দেশটাকে একটা সর্বনাশা ধ্বংস অশ্রু রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেবার কদাকার কুৎসিত অভিপ্রায় নিয়ে। তাই দিকে দিকে আজ অতি পরিকল্পিত ভাবে দলিত দরিদ্র আদিবাসী সংখ্যালঘু মানুষের উপর শুরু হয়েছে একটা বর্বর আক্রমণ। সেই যেমন বহু বছর আগে–জার্মানিতে ইহুদি জাতির সব মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রয়াস চালিয়ে ছিল মানব সভ্যতার সব চেয়ে বড় শত্রু–নাৎসি বাহিনী। আজ আবার তাদেরই উত্তরসূরিরা সেই একই রকম তাণ্ডব চালাতে চাইছে ভারতভূমির গ্রাম গঞ্জে নগর শহরে বন্দরে জনপদে। মানুষ মরবে–মানুষ আর্তনাদ করবে–রক্তের নদী বইবে গঙ্গা নর্মদা গোদাবরীর জল লাল হবে মানুষের রক্তে। আর হত্যাকারীরা হা হা রে রে করে জয়ধ্বনি দেবে। যেন সেই রক্ত প্লাবনে–জল্লাদের উল্লাস গর্জনের নীচে চাপা পড়ে যায় সাধারণ মানুষের খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা–স্বাধীনতা আর সামাজিক সম্মানের মতো মৌলিক দাবি দাওয়ার নাগরিক প্রশ্নগুলো। সংগঠিত হতে থাকা সমস্ত প্রতিবাদী আন্দোলন। জল জঙ্গল জমিনের লড়াই সব যেন ঢাকা পড়ে যায় আর্তের কান্নার নীচে।
ওরা জানে–বহু মানুষকে বঞ্চিত না করতে পারলে অল্প কিছু মানুষের প্রাপ্তির ঝুলি ঝোলা ভরে উপছে পড়তে পারে না। তাই শোষণ শাসন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যেখানেই মানুষ মাথা উঁচুকরছে, নানা কৌশলে তাদের উপর নামিয়ে আনা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী কায়দায় বর্বর আক্রমণ। সামান্য ছুতোনাতায় তারা হামলে পড়ছে সাধারণ জনজীবনের উপর। চূর্ণ বিচুর্ণ বিধ্বস্ত করে দিতে চাইছে প্রতিবাদী মানুষের মনোবল। একজন অতি সাধারণ মানুষ, সে কী খাবে, কী পড়বে, তার উপরও চালান হচ্ছে শ্যেন পাহারাদারি। ভীত ত্রস্ত করে মানুষকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে–তোমরা কেউ আমাদের ইচ্ছা বিনা এক পাও চলতে পারবে না। আমাদের অনুমতি বিনা তোমাদের কোন স্বাধীন স্বত্ত্বা থাকতে পারবে না। যুগ যুগ ধরে যেমন থেকেছে–চির পদানত, গোলাম হয়ে বাঁচতে হবে খেটে খাওয়া দরিদ্র সাধারণ মানুষকে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই নিরীহ নিম্নবর্ণ নিম্নবর্গ মানুষের উপর আজ দিকে দিকে নির্মম অত্যাচার চালান হচ্ছে–অতি পরিকল্পিত ভাবে।