সত্যিই আমি সেই বোকা ভিখারি। যে বহু পথ পার হয়ে বহু ক্লেশ সয়ে বহু চেষ্টার পরে রাজদ্বারে তো পৌঁছাতে পেরেছিল কিন্তু সাহস করে রাজভোগ চাইতে পারেনি। ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে বাসি রুটি নিয়ে। কে জানে চাইতে পারলে হয়তো রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব পেয়ে যেত। যা পাবার জন্য হাজার মাইল পথ হাঁটা।
বেবী হালদার অতি দুঃখী-দরিদ্র এবং দলিত সমাজের এক মেয়ে। তার সাফল্যে আমার কোন মনোবেদনা ঈর্ষা দ্বেষ নেই–থাকা উচিৎ নয়। সে যা পেয়েছে নিজের ভাগ্যে পেয়েছে। যার ভাগ্যে যা আছে সেই নিয়ে তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
আমি এটা জানি–বেবীকে যারা উচ্চে তুলেছে, আমার পাশে পিছনে এসে দাঁড়ানোয় খানিকটা অসুবিধা আছে। সে অতি দরিদ্র। অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের দারিদ্রের যে অন্তর্নিহিত কারণ–সেই অমানবিক শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে সে একটা লাইনও লেখেনি। ফলে, ধনকুবের গোষ্ঠীর কোন বিষ নজরে পড়েনি। তারা বেবীর প্রতি দরদ দেখিয়ে নিজেদের মানবিক মুখটা উজ্জ্বল করে নেবার সুযোগ পেয়েছে।
বেবী দলিত সম্প্রদায়ের মেয়ে। দলিতদের দলনকারী ব্রাহ্মণ্যবাদ পুরোহিত তন্ত্রের বিরুদ্ধে সে একটা কথাও বলেনি। তাই উচ্চবর্ণ সম্প্রদায়ও তার উপর খঙ্গ হস্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। দেখো আমরা কত উদার–ছোট জাতদেরও কত স্নেহ করি, এই প্রদর্শন বাতিক থেকে বেবীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে বিবেক দংশন অনুভব করেনি।
আমার লেখা তো তেমন নয়। পুঁজিবাদ পুরোহিত তন্ত্র অন্ধ কুসংস্কার সব কিছুর উপর নির্মম প্রহার থাকে। যে প্রহারে ওরা আহত হয়। তাই তারা আমার পক্ষে এসে দাঁড়াতে পারে না।
কোন রকম বিতর্কে জড়াতে হবে না–বইটা বিক্রি করে বেশ খানিকটা মুনাফাও করা যাবে এই কারণে বই ব্যবসায়ীদের বইটা ছেপে বিক্রি করতেও কোন সমস্যা হয়নি।
বেবীর বই আলো আঁধারিতে–বাপ এবং স্বামীকে সামনে রেখে পুরুষ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে খুবই হালকা কিছু আক্রমণ আছে। এটাই নারীবাদী আন্দোলনের কর্তা-কত্রীদের বেবীর বইকে হাতে নিয়ে সোচ্চার হবার সুযোগ দিয়েছে। মার্কসবাদের যে কোন ছাত্রই জানে–সব সমস্যার সমাধান গোপন আছে অর্থনীতির মধ্যে। সেই সমস্যাকে জিইয়ে রেখে কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নারীকে পুরুষ দমন-দলন করতে পারে, কারণ নারী অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল! সে স্বাবলম্বী নয়। দেখা গেছে যে নারী আর্থিক দিক থেকে সক্ষম হয়ে গেছে, তাকে আর কেউ দলন করতে পারে না। কার এমন ক্ষমতা আছে এদেশে যে ইন্দিরা গান্ধী, জয়ললিতা, মায়াবতী, মমতা ব্যানার্জী, নীতা আম্বানি–সিনেমা লাইনের কারও নাম নাই বা বললাম–এদের দমন দলন করবে?
এমনও দেখা গেছে–অধিক ক্ষমতা ধনের অধিকারী হয়ে অনেক নারীই পুরুষের জীবন স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই কারণে অসম বন্টন ব্যবস্থা কোন সমাজেরই হিত করে না। দরকার অর্থ ক্ষমতার সুসম বন্টন ব্যবস্থা। নারীবাদীরা এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে শুধু পুরুষ আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। বেবী তাদের হাতে একটা অস্ত্র দিয়েছে।
আমার লেখা এদের অপছন্দের কারণ, আমি যা লিখি সেই বিষয় বস্তুতে পুঁজিবাদ-ব্রাহ্মণ্যবাদ রাষ্ট্রীয় শোষণ এদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ থাকে। থাকে গভীরে গিয়ে সমস্যাকে দেখা এবং সমাধান কল্পে বস্তুবাদী মতাদর্শকে প্রাধান্য দেওয়া।
তাই বেবীর পিছনে যারা দাঁড়াবে আমার পিছনে দাঁড়াবার কথা নয়। কে জানে হয়ত এই কারণেই অশোকজি-সঞ্জয় ভারতী আমার অতি পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও আমাকে কোন সাহায্য করেননি। দলিত বেবীর প্রতি তাদের যে দরদ ভালোবাসা তার এককণাও আমার উপর পড়ল না। যে অলকা সারাওগী-তার উপন্যাসে আমার নামে একটা চরিত্র রেখেছেন তিনিও আমার জন্য তেমন কিছু করলেন না।
.
আমি জানি আমার এই লেখাটা পড়ে বহুলোক আমাকে অকৃতজ্ঞ বলবে। আমার এই কটু সত্য তাদের পীড়া দেবে। সে আর কী করা যাবে। আমার নাম মনোরঞ্জন কিন্তু আমার কোন লেখাই তো কারও মনোরঞ্জনের নিমিত্তে লেখা নয়। যে অনাত্মীয় অসহযোগী সমাজে আমার বাস তাকে আগামী কালের মানুষের কাছে লিলিকৃত করে রেখে যাবার ঐকান্তিক প্রয়াস। আর কিছু নয়।
আমার অভিযোগ আরও অনেকেরই বিরুদ্ধে। গৌতম রায় যথার্থ বলেছিলেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী ব্যক্তি থেকে বিষয় হয়ে উঠেছে। এই সমাজে আর কিছু নয় আমি একটা বিষয় মাত্র। আমি লিখি। যে সমাজে যে মানুষদের কথা লিখি আমি, আমার আত্মজীবনীতে যে সব দুঃখ কষ্ট অপমান অত্যাচারের কথা লিখেছি মানুষ সেগুলো পড়ে। কেউ কেউ আহা উঁহু করে। কিন্তু আমার বা আমাদের দলিত দরিদ্র সমাজের মানুষের জীবনের সেই অবস্থাটা পরিবর্তনের জন্য কেউ কোন উদ্যোগ নেয় না।
আমি লিখি, বিষয় বস্তু নয় কেউ কেউ আমার লেখার রীতি-পদ্ধতি ভুল বানান, দাড়ি কমা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কীভাবে লিখলে লেখা আরও মনোগ্রাহি হবে উপদেশ দেয়। সাহিত্য রস কত কম আছে–সমালোচনা করে। শুধু তাদের স্পর্শ করে না কাহিনীর মর্মবাণী–চির বঞ্চিতের আর্তনাদ।
এখন আমাকে লোকে প্লেন ভাড়া দিয়ে নিয়ে যায়। দশতলা হোটেলে রাখে। আলো ঝলমল মঞ্চে বসতে দেয়। সেখানে কেউ আমার সাহিত্য নিয়ে কোন কথা বলে না, সাহিত্য বিষয়ে কোন কথা আমার কাছে শুনতে চায় না। সব প্রশ্নের তির ছুটে আসে আমার ব্যক্তি জীবনের দিকে। সবার মাত্র একটা কৌতূহল এই লোকটা এত বেশী বয়সে লেখাপড়া শিখে এত মোটা বই কী করে লিখে ফেলল। তাদের চোখে আমি মানুষ নয় একটা কাক–যে কোকিলের মত ডাকতে জানে! এটা কী করে পারে–এই এক বিস্ময়।