এরপর বেবীর মা যেমন একদিন তার অত্যাচারী স্বামীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল বেবীও তার স্বামীর সংসার ফেলে চলে যায়। নানান পথ ঘুরে সে একদিন পৌঁছায় দিল্লীর গুরগাঁও। এখানে সে কাজ নেয় এক অকৃতদার অধ্যাপকের বাড়িতে রান্না বাসন মাজা কাপড় কাঁচার। বেবীর জানবার কথা নয় যে এই অধ্যাপক হিন্দি সাহিত্য জগতের সম্রাট মুন্সী প্রেমৰ্চাদের নাতি, নাম প্রবোধ কুমার।
একদিন কোন এক অবসরে বৃদ্ধ অধ্যাপকের কাছে কথায় কথায় বেবী তার দেশের বাড়ির কথা বেদনাদায়ক জীবনের কথা বলে বসে। প্রবোধ কুমার সাহিত্যিক। বেবীর কথা শুনে অধ্যাপকের মনে হয় যদি বেবী তার বিড়ম্বিত জীবন গাঁথা অকপটে লিখে ফেলতে পারে একটা অসাধারণ আত্মকাহিনী তৈরী হবে। উনি তখন বলেন–তোমার দুঃখ বেদনার সব কথা লিখে ফেলল। বাল্যকাল থেকে আজ অবধি সব লেখো। এই লেখাই তোমার জীবন বদলে দেবে। লিখতে হলে পড়তে হয়। কি করে লিখতে হবে শেখাবার জন্য কলকাতার বন্ধু অশোকজির মাধ্যমে তসলিমা নাসরিনের মেয়েবেলা আনিয়ে পড়তে দেন। পড়ো। লেখো।
বেবী তাই করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চালিয়ে যায় জীবনী লেখার কাজ। কিছুটা লেখা হলে প্রবোধ কুমারকে পড়ে শোনায়। কোথাও কোন ভুল ভ্রান্তি হলে সংশোধন করে দেন বৃদ্ধ অধ্যাপক। লেখা হয়ে যায় বেবীর জীবনী।
এরপর প্রবোধ কুমার সেই পান্ডুলিপি কলকাতার বন্ধু অশোকজির কাছে পাঠিয়ে দেন প্রকাশনার জন্য।
অশোকজি অনেক খুঁজেছেন। প্রকাশক পাননি। তাই আমাকে দিয়েছেন, যদি কোন ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমি নিজেই তো কোন প্রকাশক নিজের জন্য যোগাড় করতে পারি না। অন্যের জন্য কী করে করব! তবু চেষ্টা করি। প্রায় দু-মাস বই পাড়ায় বিভিন্ন প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরি। কিন্তু কোন প্রকাশকই এক ঝি মেয়ের আঁকাবাঁকা অক্ষরের জীবনী পড়ে দেখার উৎসাহ দেখায় না। তাই একদিন সেই পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে আসি অশোকজির কাছে। ‘আমি পারলাম না দাদাজি’।
একে বোধহয় বলে ভাগ্য। এখন যখন বেবীর বই দুনিয়া কাঁপাচ্ছে, যে সব প্রকাশক পান্ডুলিপি হাতে পেয়েও ছাপালো না–হাত কামড়াচ্ছে। অশোকজি এবং প্রবোধ কুমার দুজনেই ভীষণ জেদি মানুষ। কোন অবস্থায় যারা হার মেনে নেবার পাত্র নয়। কই বাত নেহি, বাংলায় হয়নি তো কী হয়েছে! হিন্দিতে হবে।
এবার প্রবোধ কুমার বেবীর লেখাটা অনুবাদ করে ফেলেন হিন্দিতে। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে পুস্তক প্রকাশনার জগতে অনেকবারই দেখা গেছে যে গুণমানে মূল লেখার চেয়ে অনুবাদ অনেক পোক্ত হয়েছে, মূলকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রবোধ কুমার পরিণত সাহিত্যিক অশোকজিও তাই। ফলে অনুবাদে বেবীর লেখায় যা কিছু খামতি অপূর্ণতা ছিল–ঢেকে গেল। পরে সেই হিন্দি লেখাই ইংরাজীতে অনুবাদ হয়। ইংরাজী থেকে ফিরে আসে বাংলা ভাষায়। ইংরাজি থেকে বিভিন্ন বিদেশী ভাষাতেও অনুবাদ হয়।
কাঁচড়াপাড়ার রোশনাই প্রকাশনার কর্ণধার সঞ্জয় ভারতী সে অশোকজির পরিচিত–স্নেহধন্য। হিন্দি অনুবাদটি তার হাতে দিয়ে বলেন অশোকজি এটা ছাপো সঞ্জয়। তোমার কোন দায় নেই, টাকা পয়সা যা লাগবে–আমরা দেব। এবং তখনই পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে দিলেন। কিছুদিন পরে প্রকাশিত হল বেবী হালদারের বই–আলো আঁধারি।
প্রবোধ কুমার দিল্লিতে থাকেন। দিল্লি ভারতবর্ষের রাজধানী। হাজার হাজার সংবাদ মাধ্যম প্রতিনিধি ওখানে থাকে। সবার সঙ্গেই প্রবোধ কুমারের সুসম্পর্ক। উনি তার ভরপুর সুযোগ নেন। ফলে, অল্প দিনের মধ্যে ভারতবর্ষের সব কটি টিভি চ্যানেলে প্রধান প্রধান সংবাদ পত্রে বেবীর কথা–আলো আঁধারির কথা স্থান পায়।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বেবী হালদারের, নাম যশ অর্থ সব তাকে ধাওয়া করে চলে। বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে যায় সে।
আপনারা যাঁরা বেবী হালদারের জীবনী পড়েছেন তাদের কাছে আমার একটি বিনীত প্রশ্ন–এটা ঠিক যে বেবী বহু দুঃখ কষ্ট সয়েছে। সে কী আমার চেয়ে বেশী দুঃখ কষ্ট অপমান অত্যাচার? হাঁটতে হয়েছে আমার মত প্রাণ হাতে করে বিপদ সংকুল রক্তাক্ত পথে? বারবার ফিরে এসেছে নিশ্চিন্ত মরণের মুখ থেকে–আর একবার মরবে বলে! সে কী আমার মত কঠিন পরিবেশে লেখাপড়া শিখেছে! অনাহারের যে কী বিভৎস রূপ তা কত কাছে থেকে দেখেছে! সে কী আমার মত দীর্ঘদিন পেটে গামছা বেঁধে সাহিত্যের সাথে সংপৃক্ত হয়ে রয়েছে। আমার যত গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নিবন্ধ–এ যাবত প্রকাশিত হয়েছে তার কী এর চেয়ে বেশী?
যদি এর সব কটা প্রশ্নের উত্তর না হয়–তবু সময়ের সিদ্ধান্তে বেবী বিজয়িনী। এগিয়ে আছে আমার চেয়ে এক হাজার মাইল আগে। এর একমাত্র কারণ–আমার অনেক কিছু থাকলেও একজন প্রবোধ কুমার ছিল না। একজন প্রবোধ কুমার–অশোক সাকসেরিয়ার বড় দরকার ছিল আমার। যার সর্বশক্তি বেবীর মতো নিয়োজিত হবে আমার জন্যে। তা না থাকায় আমার একক লড়াই সেই অর্থে তেমন কোন সফলতার দ্বার স্পর্শ করতে পারল না।
আমার স্ত্রী অনু আমাকে বলে–দোষারোপ করে–না কাঁদলে মা-ও বাচ্চাকে দুধ দেয় না। তুমি কাঁদতে পারোনি, তাই কিছু পাওনি। যে কেঁদেছে অনেক পেয়ে গেছে। একটু কাঁদতে শেখো–তুমিও পাবে।
এটাই আমার সবচেয়ে বড় দোষ–সত্যিই আমি মোট্টে কাঁদতে পারি না। জীবনভর এত কেঁদেছি যে সব চোখের জল খরচা হয়ে গেছে। অকারণ অপচয়ে ভাঁড়ারে আর জল নেই। জলের প্রস্রবণ শুকিয়ে খটখটে। তাই কাঁদতে পারি না। না হলে মা তো আমারও ছিল। শুধু কাঁদতে না পারার অক্ষমতায়–সেই মমতাময়ী মা আমাকে ‘আহা রে বাছা আমার’ বলে কোলে তুলে নিল না।