ণতবে যিনি মিষ্টি মিষ্টি–বাজারের চাহিদা অনুসারে প্রেমের কথা কাহিনী লেখেন তার কথা আলাদা। কিন্তু যিনি সচেতনভাবে কঠিন কঠোর গদ্যের লোক, তার তো নব নির্মাণের প্রয়োজনে যা জীর্ণ যা পুরাতন পচা গলা সেই সমাজ ব্যবস্থাকে অপসারণ উদ্দেশ্যে আঘাত না করে অন্য কোন উপায় থাকে না। ফলে, নিশ্চিন্তরূপে পুঁজিবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদ পুরুষ আধিপত্য এবং শাসন প্রশাসন তার বিরুদ্ধে যাবে। আর অতি স্বাভাবিক নিয়মে কিছু মানুষ সেই লেখা এবং লেখকের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠবে। সেই বিরূপ লোকেদের হাতে যদি থাকে প্রচুর অর্থ–প্রচুর রাজনৈতিক ক্ষমতা, তারা লেখকের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবেই। এই অবস্থা থেকে রেহাই পাবার কোন পথ খোলা নেই।
আমার ভাগ্য আমাকে সেই ভীষণ অবস্থার মধ্যে এনে ফেলেছে। কারও দোষ নেই –দোষ আমার। কারণ, আমি যে নিজেই এই অবস্থা সৃষ্টি করেছি। এখন পরিত্রাণের উপায় আমাকেই খুঁজে নিতে হবে। যদি পারি–বিজয়। যদি না পারি–বিলোপ।
লোকে বলে ভাগ্যবানের বোঝা স্বয়ং ভগবান নাকি বয়ে দেন। আর যে ভাগ্যহীন তাকে তার নিজের বোঝা নিজে উটের কুঁজের মত বয়ে নিয়ে যেতে হয়–নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। আমি শেষ দলের লোক যাকে প্রতিটা সিঁড়ি অতিকষ্টে তৈরি করে এক এক পা এগোতে হচ্ছে সামনে।
আমি মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি বালক, কোথায় পৌঁছাতে চাও তুমি? কেন এই বোঝা বইছো? এইসব লেখা লেখি দিয়ে কী পেতে চাও?
সেই যখন আমার প্রথম বই বৃত্তের শেষ পর্ব প্রকাশিত হয় আমি আমার বই বিক্রি করতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বামপন্থী অতি খ্যাতনাম্নী অধ্যাপিকার কাছে গিয়েছিলাম। বিনীত গলায় বলেছিলাম আমি একজন রিকশা চালক লেখক। একটা বই লিখেছি। একখানা কিনবেন? পড়বেন?
তিনি আমাকে মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব দিয়েছিলেন–কে তোমাকে লিখতে বলেছে! সত্যিই তো। কে আমাকে লিখতে বলেছে? যেটা যার কাজ সেটা তো তাকেই মানায়। আমি এক রিকশাঅলা, আমার কাজ তো গরু গাধার মত গাড়ি টানা। লেখালেখি এসব তো শিক্ষিত বিদ্বান লোকের কাজ। আমি শালা সেই শ্রেণীতে নাম লেখাতে চাইছি কেন! কেন লিখি আমি?
আমি কি এই পচাগলা জীর্ণ হাজার বছরের বনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে থাকা রক্তচোষা সমাজ ব্যবস্থাটাকে কলম চালিয়ে বদলে ফেলতে পারব? আমি কি জাত বর্ণের নামে পুরোহিত শ্রেণীর অমানবিক ধর্মীয় বর্বরতাকে বন্ধ করে দিতে পারি! ওই যে শিশু ফুটপাতে প্রবল শীতের কামড়ে কুঁকড়ে গেছে–এনে দিতে পারি একটা শীত বস্ত্র। ওই যে মা সন্তান কোলে কাঁদছে খিদের তাড়নায়–বসিয়ে দিতে পারি তাকে গরম ভাতের থালার সামনে!
পারি না। পারি না।
মানুষ যাক মায়ের ভোগে। আমি কী এই লেখার দ্বারা সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে পারি। পেতে পারি সেই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য যেটুকু না পেলে জীবন অচল। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা মেলে।
তাও পারি না। আমি এত শক্তিমান লেখক নই।
তবু লিখে যেতে চাই। দেশ সমাজ মানুষ এবং নিজ কারওঁ নে কাজে আসবে না, তবু লিখে যেতে চাই। কেন বেঁচে আছি তা জানি না, তবু মরতে চাই না–বেঁচে থাকতে চাই। আমি মরে গেলে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না। আমার মত কত লক্ষ কোটি এসেছে চলে গেছে, তবু আমার যেতে মন সায় দেয় না। প্রাজ্ঞ পুরুষ বলে গেছেন–জীবন লম্বা না হয় না থোক, পারলে বড় কর। বড় করতে পারিনি–লম্বা করেছি। তিন কুড়ি পার। তবু বাঁচতে চাই–লিখতে চাই।
কারণ, সেই শেষ লেখাটা যে আজও লেখা হয়নি। কেউ দিব্যি দেয়নি–এ আমার নিজের কাছে নিজের দায়। এই দায় আমাকে আজন্ম বয়ে যেতে হবে। সব অবজ্ঞা অনাদর উপহাস তিরস্কার অপমান অত্যাচার সয়ে। আর লিখতে হবে সেই শেষ লেখাটা।
সেই শিরোমণিপুর ক্যাম্পে শিশুবেলায় আমি তো মরেই গিয়েছিলাম–তারপর আবার যে বেঁচে উঠলাম সেটা ওই অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত করে যাব, বোধহয় সেই কারণে।
তাই আমি লিখি, তাই আমাকে লিখতে হবে। ১৯১৪-র শেষ পাদে এসে অশোকজি ৮১ বছর বয়সে মারা গেছেন। তখন বেঁচে ছিলেন। একদিন অশোক সাকসেরিয়ার বাড়ি লর্ড সিনহা রোডে গেছি। বুড়ো মানুষ, শরীরটা একটু সেদিন খারাপ ছিল ওনার। শোয়া থেকে উঠে বসলেন তিনি। তার পর বালিশের তলা থেকে বের করলেন আঁকা বাঁকা অক্ষরের লেখা একটা বাংলা পাণ্ডুলিপি। বললেন–আমাদের সঙ্গে তো বাংলা প্রকাশকদের খুব একটা চেনা জানা নেই, আপনার আছে। এটা একটা মেয়ের আত্মজীবনী। দেখুন যদি কোথাও ছাপাবার একটু ব্যবস্থা করতে পারেন তো খুব ভালো হয়।
একটা মেয়ে। কে সেই মেয়ে?
মেয়েটির নাম বেবী হালদার। এই পশ্চিমবঙ্গেরই মেয়ে। আমি বা বই পাড়ার প্রকাশক কে জানত যে মাত্র ক্লাশ সিক্সে পড়া বাবুর বাড়ির কাজের মেয়ে বেবী–তার এই আত্মজীবনীর জন্য একদিন পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে যাবে। ছাব্বিশটা ভাষায় ছাপা হবে তার বই। লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা দেবে। বদলে যাবে বেবীর অবহেলিত জীবন।
বেবীর বাবার তিন বিয়ে। প্রথম পক্ষের বউ বেবীর মা তার চার পাঁচ বছর বয়েসের সময় তাকে ফেলে চলে যায়। বেবী বড় হয়ে ওঠে বিমাতাদের অনাদর অত্যাচার সয়ে সয়ে। যখন তার মাত্র তের বছর বয়স বিমাতা আর মদ্যপ বাপ মিলে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় তার দ্বিগুণ বয়সের এক ভ্যানচালকের সাথে। সেও ছিল মদ্যপ এবং অত্যাচারী। সে মদ খেয়ে বেবীকে খুব মারত পেট ভরে খেতে দিত না।