আমি বাড়িতে।
আমরা এসে গেছি। তাড়াতাড়ি আসুন।
দোষটা আমার নয়–তাদের। বিভিন্ন চ্যানেলে বহুবার ইন্টারভিউ দিয়েছি। অভিজ্ঞতায় জানি–কাল আসব বলে আসে তিনদিন পরে। একবার তো এখনই আসছি বলে যে গাড়ি আমার বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিল–মাঝপথ থেকে ঘুরে এক দুর্ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে চলে যায়। তাই ২৪ ঘণ্টার কথায় নেচে উঠিনি। ফোন আসুক তখন যাব। এতেই মুশকিল হয়ে গেল।
তখন আমি সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি। ফোন পেয়ে চা প্লেটে ঢেলে মুখ পুড়িয়ে খেয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হই। আমার সবদিনের বাহন সাইকেল। ভাগ্য ভালো তখনই একটা স্যাটেল ট্যাক্সি পেয়ে যাই। সাইকেলে বিশ মিনিট লাগে ট্যাক্সি পনের মিনিটে পৌঁছায়। মাঝ পথেই একবার আবার সাংবাদিকের ফোন পাই। আপনি কত দূরে? বলি পাঁচ-সাত মিনিটে এসে পড়ব। ট্যাক্সিতে আছি।
বলে সে, আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আসুন আপনি। গলার স্বরটা যেন কেমন কেমন। মোটেই একজন লেখকের প্রতি সম্মান সভ্রম সূচক নয়। যেন অভদ্র ভাষা ~ আয় শালা তোকে মজা দেখাচ্ছি। বুঝতে পারছিলাম–হেনস্থা কপালে আছে। তবু এলাম। শেষটা না দেখে কী করে যাই।
আমি আসা মাত্র ঝাঁঝের সাথে বলে সে–আমরা কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সময়ের দাম নেই! বললাম সাড়ে আটটায় আসব। আপনার থাকা দরকার ছিল। কেন থাকেননি?
বলি আমি, বড়জোর দশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছেন। তা আপনারা যখন রওনা দিলেন পোদ্দার কোর্ট থেকে একটা ফোন করে দিতে পারতেন। তাহলে তো দেরি হতো না।
কেন ফোন করব! কাল তো বলে দিয়েছি!
হ্যাঁ কাল বলেছেন। আজ তো আপনাদের অন্য জরুরি কাজ পড়ে যেতে পারে। আমি কি করে বুঝব? আমারও তো শরীর খারাপ বা কোন বিপদ আপদ ঘটে যেতে পারে!
সে এক সম্মানীয় চ্যানেলের সাংবাদিক। কথা বলছে একজন তুচ্ছ রাঁধুনির সাথে, যাদের মুখ টিভির পর্দায় দেখাবার জন্য বিগলিত হয়ে যাওয়া উচিৎ। আর আমি কথা বলছি এক লেখক হিসেবে। দাবি করছি সেই সম্মান। যে লেখকের সংবাদ বিক্রি করে এই সব লোক অনেক অনেক কামায়। ফলে, দুজনের গলার স্বর উচ্চগ্রামে উঠতে থাকে। যাকে রীতিমত ঝগড়া বলে।
তখন বলি তাকে–আপনি আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন? না কি আমি কোন দরকারে গেছি আপনার দরজায়? আপনি এভাবে ধমকে কথা বলছেন? আমি কী আপনার কর্মচারি! আপনি আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন। ইচ্ছা না থাকলে চলে যাবেন। দশ মিনিট আমার জন্য নষ্ট হয়েছে বলে আপনি গরম দেখাচ্ছেন, তাহলে আপনার জন্য আমি দুঘণ্টা কেন নষ্ট করব? যান, ইন্টারভিউ দেব না।
বলেই আমি হাঁটা দিয়েছি সামনের দিকে। এত ইন্টারভিউ হয়েছে। তবু তো জীবনের কিছু বদলাল না। সেই তো খুন্তি নাড়া। আর একটা না হলে কী এমন ক্ষতি হবে?
হেঁটে হেঁটে আমি যখন বেশ কিছুটা চলে গেছি ওরা গাড়ি নিয়ে গিয়ে আমার পথ আটকায়, চলে যাচ্ছেন যে।
যাব না তো কী করব?
আমি চ্যানেলে গিয়ে কী জবাব দেব?
সেটা আপনার ব্যাপার।
না, না, আপনি ইন্টারভিউ দিয়ে যান।
দেব। আগে প্লিজ বলুন।
সাংবাদিকেরও কোন দোষ নেই। তার একটা প্রোগ্রাম বেলা তিনটায় টেলিকাস্ট হবে। এখানের কাজ সেরে ফিরে গিয়ে সেটার এডিটিং করতে হবে। মাথায় রয়েছে সেই চাপ। তাই মাথা গরম।
পরে সে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমার কর্মস্থলের শুটিং সেরে আমার বাড়ি গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাঁদেমির পদক, চারদিকে ছড়ানো অজস্র মানপত্র, ভারতবর্ষের প্রথম শ্রেণির সবকটা পত্রিকায় আমার ছবি-খবর, আমার লেখা বইয়ের গাদা সব দেখে বলে সে, ক্ষমা করবেন। মাথাটা ঠিক ছিল না। আজেবাজে বলেছি। পরে একদিন আমি আবার আসব।
সত্যিই সে এল দিন সাতেক পরে। দিয়ে গেল একটা চিঠি। সোনার বাংলা হোটেলে ১৪২০-র ২৪ ঘণ্টা অনন্য সম্মান অনুষ্ঠানে আমার আমন্ত্রণ। বলে গেল সে–আমি তো যাবই আমার সঙ্গে একজন সঙ্গী নিয়ে যেতে পারি। নির্দিষ্ট দিনে গাড়ি এসে আমাকে নিয়ে যাবে।
সেদিন গিয়ে জানতে পারলাম–এই বছর আমাকে মনোনীত করা হয়েছে এই সম্মানের জন্য। আরও একজন সাহিত্যিক পাচ্ছেন এই সম্মান তিনি বুদ্ধদেব গুহ।
সেসব তো হল। অনন্য সম্মান তো পেলাম। চ্যানেল দিল পঁচিশ হাজার টাকার চেক, মানপত্র, ট্রফি আর সেনকো গোল্ড দিল একখানা রূপোর স্মারক–নয় দশ ভরি ওজনের।
এখন এক একদিন মনে মনে ভাবি সেদিন যদি ইন্টারভিউ না দিয়ে চন্ডাল রাগের পিঠে সওয়ার হয়ে চলে যেতাম–ওসব তো পেতাম না। টাকা তো খরচ হয়ে গেছে। রয়ে গেছে মানপত্র স্মারক। অন্ততঃ তিন চারবার পুরো প্রোগ্রামটা টেলিকাস্ট হয়েছে।তাইবহু মানুষ জেনেছে আমার কথা। বেশ কিছু বই বিক্রি হয়েছে। পাঠক বেড়েছে আমার বইয়ের। সব ফুস হয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে।
একটা প্রাপ্তি হারিয়ে যাচ্ছিল অহেতুক ভয়ে আর একটা চলে যেতো অকারণ ক্রোধে।
#
আমাকে লিখতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। তবু লিখি। না লিখে পারি না, তাই লিখি। মহা সমুদ্রে ডুবে যাওয়া একজন মানুষ যেমন বেঁচে থাকার আকুল আকাঙ্খায় হাতের কাছে যা পায় আঁকড়ে ধরে আমি ধরে রেখেছি সস্তা দামের একটা কলম। এবং এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর জন্য কারওর কাছে কোন সহযোগিতা পাব তেমনটা আশা না করাই ভাল। যদি পাই উত্তম, না পেলেও হা হুতাশ করার কিছু নেই। লেখন ক্রিয়া যেহেতু এটি একটি সৃজন নির্মাণ বা আন্দোলন, এর একটা অভিমুখ তো থাকেই।