তাহলে যারা সমাজের জন্য কিছু করবে না, সমাজ তাদের জন্য কিছু করবে কেন!
আজ মনে হয় সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসে গেছে, একদল লোক কবে কোনকালে এক দলিত পরিবারে জন্মেছিল, মাত্র সেই কারণে দলিত সমাজের কোন উপকার না করে–দলিতদের জন্য সংরক্ষিত রাখা সব মধু চেটে পুটে খেয়ে নেবে। এর বিরুদ্ধে দলিত সমাজের মধ্য থেকেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠা। প্রয়োজন মনে করলে তাদের ‘তনখাইয়া’ ঘোষণা করে সামাজিক বয়কট করা।
দলিত সমাজ অন্য অহিতকারীদের সাথে তো লড়ে নেবে সে শক্তি তার আছে। পারবে না যদি নিজের মধ্যের কেউ মুখে এক কর্মে অন্য রকম হয়। এদের চিহ্নিত করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা দরকার। সে যাই হোক, তবে আমাদের এইসব দলিত সাহিত্যিক খ্যাতি প্রত্যাশী বড় বড় সরকারী চাকুরেদের এটাই হয়ে গেছে মহা সমস্যা। সংরক্ষণের দৌলতে যত সহজে সরকারি চাকরি মিলে গেছে অত অনায়াসে সাহিত্যিক স্বীকৃতি মেলে না। সেখানে প্রতিযোগিতা বড় কঠিন। একশোতে তেত্রিশ পেয়ে পাশ এখানে চলে না। একশোতে পূর্ণ মার্কস একশোই চাই। এই একটি ক্ষেত্রে কেউ দয়া কৃপা দেখাবে না। এক ইঞ্চি জমি ছাড়বে না। সম্পূর্ণ যোগ্যতার বলে আসনটি অধিকার করতে হবে।
আমাদের মধ্যের কেউ কেউ সাফাই দেয়–“আমরা এক পুরুষের শিক্ষিত’। এটা কোন কথাই নয়। আপনি ওয়ান থেকে গ্র্যাজুয়েট যে বই পড়ে হয়েছেন, যে স্কুল কলেজের যে সব মাস্টার আপনাকে পড়িয়েছে তাকেও–তাই। তাহলে আপনি তার চেয়ে কম কীসে? কম ওই–আগ্রহের। কম ওই আয়ত্ব-আত্মীকরণের নিষ্ঠা একাগ্রতার। আর বেশী হচ্ছে সবকিছু অতি আয়াশে পেয়ে যাবার প্রবণতা।
এই প্রবণতা আমাদের রক্তের মধ্যে আছে। আমরা এক গুরুর শিষ্য হই। তার পায়ে প্রণতঃ হই আর আশা করি আমার কিছু করতে হবে না–যা কিছু সমস্যা সব গুরু দূর করে দেবে। যে। নিজের সমস্যা দুর করতে পারে না। সে দূর করবে আমার সমস্যা?
আমরা কালী শিব নানান ঠাকুর দেবতাকে লোভ দেখাই যদি আমার একটা চাকরি হয়, লটারিতে লাখ টাকা পাই তোমাকে পাঁচসিকে মানত দেব। ঠাকুর তো একটা হাঁদারাম যে পঁচিশ হাজার টাকা মাস মাইনের চাকরি বা লাখ টাকার লটারী আমাকে দেবে পাঁচসিকে পাবার লোভে!
আমাদের নমশূদ্রদের সবচেয়ে বড় তীর্থ পশ্চিমবঙ্গে ঠাকুরনগর। হরিচাঁদ ঠাকুরের নাতি পুতিরা ওদেশ থেকে পালিয়ে এপার বঙ্গে এসে বেশ ক’বিঘে জমি কিনে ঘর বাড়ি বানিয়েছিল। নীচু জমি উঁচু করার প্রয়োজনে প্রচুর মাটি চাই, তাই খনন করেছিল বড় একটা পুকুর। তার নাম দিয়েছে কামনা সাগর। এই পুকুরে নাকি যা মনস্কামনা নিয়ে ডুব দেওয়া হবে–সব পূর্ণ হয়ে যাবে।
আমাদের লোকজন বহু পথ পার হয়ে গিয়ে সেই পুকুরে ডুব দিচ্ছে। কী তাদের কামনা, পূর্ণ হচ্ছে কী হচ্ছে না, কে জানে? যদি হয় তাহলে আমার পরামর্শ একজন ডুব দিয়ে মনে মনে বলুক ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হবো। একজন বলুক মুকেশ আম্বানী হবো। একজন বলুক অমিতাভ বচ্চন হবো। এইভাবে সমাজের সবকটা শীর্ষ স্থান আমরা পেয়ে যেতে অসুবিধা হবে না।
ওই সাহিত্য শীর্ষে ওঠার জন্য উদগ্রীব লেখককেও বলব–একটা ডুব দিয়ে নিন। আর তা না হলে একাগ্রচিত্তে সাধনা করুন। যত মহৎ সাহিত্য আছে সব পড়ুন। শিখুন কেমন করে লিখতে হয়। সেই যে চশমা পরা খালি গায়ের লাঠিতে ভর দেওয়া বুড়ো–অনেক কথার সাথে তার একমত হওয়া যায় না–সেটা সত্যি। তবে সে যে বলেছে চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কার্য সিদ্ধ হয় না। এটা একশোর মধ্যে একশো দশভাগ সত্যি।
আর সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই কথাটা আরও বেশী সত্যি।একজন বড় রাজনেতা তার ছেলেমেয়ে বাপের নাম ভাঙিয়ে নেতা হয়ে বসতে পারে। এক ধর্মগুরু–তার ছেলেও হয়ে যেতে পারে ধর্মগুরু। রাজার ছেলে রাজা, জমিদারের ছেলে জমিদার হয়ই। কিন্তু সাহিত্যের অঙ্গন অত সহজলভ্য নয়। তাই কোন বিখ্যাত লেখকের ছেলে সেই সুযোগ পায়নি। যে হয়েছে সে বহু সাধ্য সাধনায় হয়েছে।
এইখানে হেরে যাচ্ছে আমাদের নমশূদ্র লেখকরা। সবাইনয়, অনেকের আপ্রাণ প্রয়াস আছে, তবে অধিকাংশই ফাঁকি দিয়ে আদায় করতে চাইছে ওই আসন। পারছে না, তাই যে বা যারা তাকে ছাড়িয়ে একটু উপরে উঠছে–ক্ষোভে দুঃখে বিষোদগার করছে।
যাদবপুর ইউনিভাসিটির তুলনামূলক সাহিত্যের এক অধ্যাপক গেছেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এক সাহিত্যের অনুষ্ঠানে।তিনি সেখানে পাঠ করলেন পশ্চিমবঙ্গের জেলখাটা রিকশাঅলার লেখা একটি গল্প। গল্পের নাম রিবাজ।
ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির এক ডেপুটি রেজিস্ট্রারও সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। তিনি চেপে ধরলেন অধ্যাপককে, মশাই আপনি কী আর লেখক পেলেন না। শেষকালে এক রিকশাঅলার লেখা!
বলেন অধ্যাপক, আমি কী করব বলুন রিবাজ গল্পটা যে ওই লোকটার লেখা। আপনি একটা রিবাজ লিখুন, পরে যে অনুষ্ঠানে যাব সেখানে সেটাই পড়ব।
আমি কোন মন্তব্য করব না। সব কথার শেষ কথা তো অধ্যাপক বলে দিয়েছেন। আমি শুধু বাসের পিছনে লিখে রাখা লেখাটা পড়ব। হিংসা কোরো না। চেষ্টা করো, তোমারও হবে।
***
কথা হচ্ছিল ২৪ ঘণ্টা চ্যানেলের বিষয়ে। চলে গেছি বিষয়ান্তরে। সেই কথায় ফিরে আসি।
সেদিন মঙ্গলবার। প্রস্তুত হয়ে আছি ফোন আসবে। ফোন এল সেই সাড়ে আটটায়। তবে তখন তাদের গাড়ি বাইপাস পার হচ্ছে। আপনি কোথায়?