বলেন তিনি, বই এনেছেন?
না তো।
তাহলে কী করতে এসেছেন! আমি এতদূর থেকে এসে কী আপনাকে দেখে খালি হাতে ফিরে যাব?
বলেন নি তো যে বই লাগবে। যদি ফোনে একবার বলে দিতেন।
হ্যাঁ, আমারই একটু ভুল হয়ে গেছে!
একটু ভেবে বলেন তিনি, আপনার বাড়ি এখান থেকে কতদূর? চলুন, আপনার বাড়ি যাব। সাইকেল এখানে তালা মেরে রেখে দিন। গাড়িতে বসুন। ফিরে এসে সাইকেল নিয়ে যাবেন।
আমার বাড়ির পথ বড় এবরো খেবরো। মিনিট পনের পরে বাড়ি পৌঁছে আমার বেশ কখানা বই নিলেন তিনি। দাম কত হল? হিসেব করে দেখলাম তেরশো চল্লিশ টাকা। তিনি পকেট থেকে একটা বান্ডিল বের করে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে, এটা রাখুন।
কত আছে এতে?
পাঁচ হাজার।
এত কেন?
আপনাকে দিলাম। তেরশো চল্লিশ বাদ দিয়ে যা থাকে আপনার কাজে লাগবে। কাগজ কলম কিনবেন।
এক কাপ চাও খেলেন না আমার বাড়ি। আমাকে পাশে নিয়ে কোন ছবিও তুললেন না। কী নাম, কোথায় বাড়ি কিছুই জানালেন না। নিঃশব্দে নাম ফাটানো থেকে নিবৃত্ত থেকে চুপচাপ চলে গেলেন দরদী মানুষটা। এই মানুষটার নাম নিশীথ সরকার।
পরে অনেকবার ভেবেছি–কী বিরাট একটা ভুল হয়ে যেত আর একটু হলে। যদি মানুষটার সাথে ভয়ে দেখা না করতাম আজীবন কত বড় একটা ভ্রান্তি বয়ে বেড়াতে হতো। বন্ধুর গায়ে লেগে থাকত বৈরীর একটা অমূলক সন্দেহ।
এই বন্ধুটি আজ দলিত সাহিত্য সংস্থার অনুষ্ঠানে আসবে। তারপর ভেসে যাবে সমুদ্র পথে। আবার কবে কতদিন পরে ফিরবে ভারতে–কোন ঠিক নেই। যাবার আগে একবার আমার সাথে দেখা করে যেতে চান। তাই আমার যাওয়া। আমার এক মিত্র অনন্ত আচার্য-সেও যাবে। উল্টোডাঙ্গা থেকে তার সাথে একই বাসে গেলাম। যেতে যেতে বললাম আমি কিন্তু মঞ্চে উঠব না। বক্তৃতা দেব না।
আমি নিজেকে নিয়ে সব সময় বিব্রত। জন্মের সময় আমার মুখে মধু পড়েনি। ফলে মুখের ভাষা মিষ্ট নয়। লিখতে গেলেও কলমের মুখে এসে জমা হয় জীবন যন্ত্রণার তীব্র গরল। বহু মানুষের যেটা ভালো লাগে না। যা লিখি যা বলি–একটা বিতর্ক তৈরী করে। আজ আমার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার মোটে ইচ্ছা নেই।
না, পাশ কাটানো গেল না। দলিত সাহিত্য সংস্থার কল্যাণীর এক কর্মকর্তা মাইকে নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে দিল আমার। অগত্যা না গিয়ে উপায় নেই। আর যা হবার তাই হল। আমার বক্তৃতার পর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন এক লেখক।
আমি বলেছিলাম বাংলা দলিত সাহিত্য হিন্দি মারাঠী গুজরাটি কন্নর তামিল তেলেগু ভাষার দলিত সাহিত্যের তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে। বলেছিলাম যে–এর জন্য দেশভাগ অনেকটা দায়ী। বাংলার সবচেয়ে সচেতন সংগঠিতদলিত সম্প্রদায় হচ্ছেনমঃশূদ্র। মাহার বাদে যে জনগোষ্ঠী বাবা সাহেব-ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের পিছনে সবচেয়ে আগে এসে দাঁড়িয়েছিল সে ওই নমরা।–বাবা সাহেবকে সংবিধান সভায় নির্বাচিত করে পাঠিয়েছিল। দেশভাগজনিত কারণে এই শক্তিশালী জনগোষ্ঠী ছিন্নভিন্ন হয়ে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। তখন তাদের সামনে বড় হয়ে দেখা দেয় অস্তিত্বের সংকট। থাকব কোথায়, খাব কী-বাঁচব কী ভাবে! সেই সংকট কাটিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পঞ্চাশ ষাট বছর কেটে গেছে। এমন বিপদে ভারতবর্ষের অন্য কোনও দলিত গোষ্ঠীকে পড়তে হয়নি। তাই তারা এগিয়ে গেছে।
লেখক বাবু এই কথায় ক্ষেপে গেলেন। আসল রাগের কারণ তো অন্য। তবে এখন–যখন মওকা একটা পাওয়া গেছে মনোরঞ্জনকে একটু ঠেসে দেওয়া যাক। বলে সে, আমি আমার পত্রিকায় একশো দলিত লেখকের নাম ঠিকানা বইয়ের তালিকা ছেপেছিলাম। কমপক্ষে এক হাজার বই। তবু উচ্চবর্ণরা বলে বাংলায় নাকি দলিত সাহিত্য নেই। আমাদের কিছু লোকও সেই সুরে সুর মেলাচ্ছে। তারা ওই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পক্ষে চলে গেছে।
বলে সেই বাবু লেখক–প্রচার নেই বলে আমাদের বই বিক্রি হয় না। হল-এ তখন শ খানেক লোক। তাদের বলেন–এই ক’জন পাঠক যদি পাই অবহেলায় আমি রবীন্দ্র পুরস্কার ছেড়ে দিতে পারি।
বক্তৃতায় খুব তালি পান লেখক। আমার তখন বলতে ইচ্ছা করছিল–বাপু হে–চরণদাস চোর বলেছিল, সোনার থালায় ভাত খাবে না। হাতিতে চড়বে না, রাণী বিয়ে করবে না, রাজা হবে না। কারণ এই সব প্রাপ্তি সম্ভাবনা তার কল্পনার হাজার মাইলের মধ্যে ছিল না। আপনি বলছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। সেটা যদি খুব বড় প্রতিজ্ঞা হয়–আমি বলছি নোবেল নেব না–বুকার ম্যাগসেসাই নেব না। কী যায় আসে এইসব ফাঁকা আওয়াজে। এতে নির্বোধের হাততালি হয়ত মেলে বুদ্ধিমান হাসে—’আঙুর ফল টক’ বলে।
আমি দলিত সাহিত্য নেই তা বলিনি। বলেছি তেমন উল্লেখযোগ্য কৃতী নেই। বাংলা ভাষা সাহিত্যের মূল ধারায় প্রতিনিধিত্বকারী যে সব কালজয়ী রচনা সম্ভার রয়েছে–অন্ততঃ একশো বইয়ের নাম এক নিঃশ্বাসে বলা যায়–আমাদের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বাদ দিলে আর একখানাও সেই পর্যায়ের উচ্চাঙ্গ রচনা নয়।
ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র–সে বলেও কোন ফল হবে না। আমাদের যে দুর্বলতা তা স্বীকার করতে হবে। পারিনি, তবে হতাশ বা নিরুদ্যম নই। চেষ্টা করছি, শিখছি এবং লিখছি। এভাবে একদিন নিশ্চয় পেয়ে যাব সাহিত্যের সম্মানের সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়ে দিতে। একথা বলতে লজ্জার কী আছে?