এই মানুষটা একটা অদ্ভুত মানুষ। জাহাজে চাকরি করে। ছয় মাস থাকে জলে ছয় মাস ডাঙায়। কবে কোথায় কে জানে কার মুখে আমার কথা শুনেছিলেন। একদিন মুকুন্দপুরে এসে আমার কাছ থেকে খান কয়েক বই সংগ্রহ করে নিয়ে যান। বলে যান জাহাজ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। ফিরে এসে দেখা করবেন।
প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়। কতরকম প্রতিশ্রুতি দেয়। ফোনও আসে কত অচেনা নম্বর থেকে। সব কী আর মনে থাকে। বয়স বাড়ছে স্মৃতিও আগের মত তত প্রখর নেই। তাই এই লোকটির কী নাম জানতে চাইনি। পরে এসে দেখা করবে সে কথায় অতটা আস্থা রাখিনি। অমন তো সবাই বলে। কে বা পরে আর আসে!
বেশ কিছু দিন পরে একটা ফোন এল অচেনা এক নম্বর থেকে, কী দাদা গলাটা চিনতে পারছেন? মনে আছে আমার কথা? আমি এখন সুয়েজ খাল পার হচ্ছি। শোবার আগে ভাবলাম আপনার বইটা একটু পড়ি, তাই পড়া শুরু করেছিলাম। কী করেছেন মশাই, এইসব কেউ লেখে। এইভাবে কেউ লেখে। ঘুমের বারোটা বেজে গেল। বই মোটে ছাড়তে পারছি না। আমি এসেই আপনার সাথে দেখা করব। অনেক বই নেব। আমার চেনাজানা সবাইকে দেব।
মাঝে তিন চার মাস আর কোন খবর নেই। বিদেশে ফোন করলে অনেক টাকার বিল হয়। আমারও তাই ফোন করা হয়ে ওঠে না। সে কলকাতায় ফিরে নিজেই আমাকে ফোন করে, কেমন আছেন? আমি ফোন করেছিলাম। চিনতে পেরেছেন আমাকে?
না, চিনতে পারিনি। সত্যিই চিনতে পারিনি। আগের দুবার যে যে ফোন করেছে সে নাম্বার অন্য। নাবিক দাদা নামে সে নাম্বার সেভ করা আছে। এটা অন্য নাম্বার। তবু বলি হা হা চিনেছি। বলুন কেমন আছেন?
ভালো আছি। আমি আজ বিকেলে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে যাব। একটু দরকার আছে। আপনি কী ওখানে আসতে পারবেন। এলে দেখা হয়।
যাদবপুর আমার প্রিয় জায়গা। ওখানে কফি হাউস আছে। যেখানে আমার পরিচিত কবি লেখকদের আড্ডা, অনেকদিন যাই না। এই সুযোগে না হয় একবার দেখা সাক্ষাৎ করে নেব।
বলি, ক’টায় আসবেন আপনি?
এই পাঁচটা ছটা। আমি আপনাকে আসার আধঘন্টা আগে ফোন করে দেব। ফোন আসে রাত সাতটা নাগাদ। দাদা একটা জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিলাম। এখন আমি আসছি। আমার কলেজ স্ট্রীটে একটা কাজ আছে। আপনি আমার গাড়িতে বসবেন কথা বলতে বলতে যাব। কাজ সেরে আপনাকে যাদবপুরে এনে নামিয়ে দিয়ে যাব।
তখনও মানুষটাকে চিনে উঠতে পারিনি। তাই মনে সন্দেহের দোলাচল। আমি গাড়িতে বসলাম, … গাড়ি যাচ্ছে …… কিছু দূর যাবার পর দুজন লোক উঠে পড়ল আমার দুপাশে দু দরজা দিয়ে। তুলল গাড়ির মালিকই। “আমার চেনা”। তারপর গাড়ি বেঁকে গেল চেনা পথ ছেড়ে অচেনা পথের দিকে। নিরালা নির্জন অন্ধকারের নিঃঝুম পথে। পাশের দুজন আমার পেটের কাছে চেপে ধরেছে ধাতব নল। কোন টু শব্দ করবি না। যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চুপচাপ চল। যদি এমনটা হয়? আমার শত্রুপক্ষ যদি এভাবে কোন ষড়যন্ত্র করে থাকে? নিয়ে গিয়ে যদি মেরে রেললাইনে শুইয়ে দেয়? শঙ্কাটা শুধু আমার নয়–আমার স্ত্রী অনুরও।
বলে সে, যদি তার দরকার আমাদের বাড়ি আসবে। এদিকে সেদিকে ডাকবে কেন? ব্যাপারটা সন্দেহজনক।
তাই ভদ্রলোককে বলতে হয়, না দাদা, রাত হয়ে গেছে। শরীরটাও খুব একটা ভালো নেই। অন্যদিন দেখা হবে। আজ ছেড়ে দিন।
দিন কয়েক পরে আবার ফোন, আবার সেই যাদবপুরে আসিবার জন্য ডাক। সেদিন পাশ কাটাই ডিউটি আছে বলে। দিন দশেক পরে আবার ফোন, আমি আপনাদের মুকুন্দপুরে আসছি। একবার দেখা করতে পারবেন?
জানতে চাই কখন আসবেন?
সন্ধ্যা ছটা সাড়ে ছটা।
এদিন আমার মুকুন্দপুরে আসতে হবে। দৈনিক জাগরণ পত্রিকা এবার লক্ষ্ণৌয় একটা অনুষ্ঠান করবে। আমি সেই অনুষ্ঠানের এক আমন্ত্রিত বক্তা। ওরা ই-মেলে আমার যাবার টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে। এক সাইবার কাফে-এর আই ডি ব্যবহার করতে পারি। সেই টিকিট নিতে আমি যখন মুকুন্দপুরে আসবই দেখা করে নেব। এত যখন তাগিদ আমাকে না দেখে তো ছাড়বে না। তবে আজই হয়ে যাক। অন্য জায়গার চেয়ে মুকুন্দপুর আমার পক্ষে খানিকটা সুবিধাজনক।
বলি আমি যাব। যেখানে অটো স্ট্যান্ড সেই মোড়ের শেডের নীচে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।
শীতকালের সন্ধ্যে। পথে লোকজন অপেক্ষাকৃত কম। একটা হালকা কুয়াশা জড়িয়ে আছে সন্ধ্যার অন্ধকারের গায়ে। নির্দিষ্ট সময়ে সাইকেল বাহনে আমি গিয়ে নামি অটোস্ট্যান্ডের সামনে। তখনই ফোন আপনি কোথায়?
যেখানে থাকব বলেছিলাম। অটো স্ট্যান্ডের ছাউনির নীচে।
ওখানে অনেক লোকজন। কথা বলা যাবে না। আপনি যেখানে ওয়ান-এ বাস স্ট্যান্ড, তার পিছনে যে মাঠ ওখানে চলে আসুন। দেখবেন একটা লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ওটা আমার। বিশাল এই মাঠটার নাম এফ.সি.আই মাঠ। এখন মাঠ একেবারে ফাঁকা। বিকালে যে বাচ্চারা ফুটবল খেলে, যে বয়স্করা হাঁটাহাঁটি করে, যে যবুক যুবতীরা গল্প গুজব করে–সবাই চলে গেছে। মৃদু আলোর মধ্যে শীত কুয়াশায় ডুবে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে লাল গাড়িখানা।
যাব কী যাব না! একটু মানসিক দোলাচল। মাঠের সামনে থেকে একটা রাস্তা নিতাই নগর হয়ে রুবীর দিকে চলে গেছে। এই পথে কোন লোকজন-গাড়ি ঘোড়া নেই। কোন অঘটন ঘটিয়ে গাড়ি এই পথে সরে পড়বে না তো।
যা হয় হোক! সাইকেল চালিয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তখনই চিনতে পারি তাকে। আরে! এ আমি কাকে সন্দেহ করে বসেছি। এ তো আমার পাঠক। আমার স্বজাতি।