***
সুর্য যখন উদয় হয় সারা পৃথিবীতে আলো দেয়। তবে সে আলোতে আমার খুব একটা উপকার হয় না। হয় সেই টুকু যা সবার হয়। আমার কাছে সুর্যের চেয়েও বড় প্রিয় বড় আপনার, অনেক বেশী কাজের মাটির সেই ছোট্ট প্রদীপখানি। যা আমার কুড়ে ঘরের অন্ধকার দূর করে। ভীতিকারক কালো তমসাকে দূরে সরিয়ে দেয়।
জীবনের এক এক পর্বের সূর্য সমান তেজবান উজ্জ্বল কিছু ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় যে হয়নি তেমন নয়, তবে তা খুব একটা কাজে আসেনি। এসেছে নামহীন গোত্রহীন অখ্যাত অতি সাধারণ অনেক মানুষ। যাদের ছোট ছোট সহযোগ না পেলে আমি এইখানে পৌঁছাতে পারতাম না হয়
আমি একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, কোন ব্যক্তি মানুষের একক প্রয়াস কখনই সাফল্যমন্ডিত হতে পারে না। সময় আর সমাজের বহু মানুষের নিভৃত সহযোগ থাকে। আপাতঃদৃষ্টিতে তা হয় তো তুচ্ছ, তবে সেটাও যে সেইটুকু সময়ে অতি বড় ভূমিকা নিয়েছিল এটাকে স্বীকার না করলে অন্যায় হয়।
.
রাগ চণ্ডাল–রেগে গেলে যে কোন মানুষের মাথা গরম হয়ে যায়। আর মাথা গরম হলে যে সিদ্ধান্তই নেবে ভুল হতে বাধ্য।
মানুষ রাগলে চণ্ডাল হয় আর আমি জন্মজাত চন্ডাল। চন্ডাল যদি রাগে সে যা হবে বলার মত নয়। রাগ আমি জীবনে বহু বার করেছি, ক্ষয়ক্ষতিও তার জন্য কম হয়নি। তবু শিক্ষা হল কই। এই সেদিন রাগের মাথায় আর একটু হলে বঙ্গসাহিত্যের একটা বড় শিরোপা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। যে শিরোপা পাবার জন্য কত মানুষ কী চেষ্টাটাই না করে চলেছে। আর সেই শিরোপা নিজে হেঁটে এসে আমার দরজা থেকে ফিরে চলে যাচ্ছিল আমার চন্ডাল রাগের গুতোয়।
।এক টিভি সাংবাদিক থাকেন এই মুকুন্দপুরে। চাকরি করেন ২৪ ঘন্টা সংবাদ চ্যানেলে। তার উপরওলা আদেশ দিয়েছে যাও তোমাদের ওদিকে একটা লোক থাকে, লেখে টেখে, ওর একটা ইন্টারভিউ নিয়ে এসো।
কোথায় থাকে সে?
ওই যে বোবা স্কুল ওতে রান্না করে।
রান্না করে। তবে যে বলেন লেখে!
হ্যাঁ, লেখেও রান্নাও করে। শুনেছি তার আগে রিকশাও চালাত। জেলে টেলেও গেছে।
এই লোকের ইন্টারভিউ!
হ্যাঁ, সিইও আমাকে বলেছে, আমি তোমাকে বললাম অন্য কাজ পরে হবে সবার আগে এটা সারো।
সাংবাদিক আমার মোবাইলে ফোন করলেন, ২৪ ঘণ্টা চ্যানেল থেকে বলছি। আমি আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই। তাড়াতাড়ি দরকার। কখন আপনার সময় হবে?
চলে আসুন আজ বিকালে।
একটু ভেবে বলে সে–আজ না, যদি কাল যাই কোন অসুবিধা হবে?
ভালো হবে। কাল আমার ছুটির দিন, কোন তাড়াহুড়ো থাকবে না। সারাদিন বাড়িতে থাকব। যখন খুশি আসতে পারেন।
আপনার কাল ছুটি?
হ্যাঁ, কাল আমার রবিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন।
তাহলে আপনি যে রান্না করেন, সে ছবি কী করে পাবো। ওটা যে চাই।
বলি–তাহলে সকালে নটার আগে আসতে হবে। তারপর হবে না। নটার মধ্যে রান্না শেষ হয়ে যায়। সন্ধেয় ফের শুরু হয় ছ’টায়। যখন আপনারা আসবেন একটা ফোন করে দেবেন। আমি কাজের জায়গায় এসে যাবো।
আমরা সকালে সাড়ে আটটার মধ্যে আসব। আপনি থাকবেন।
আমাকে প্রায় সব বাংলা চ্যানেল এক দুবার ডেকেছে। তারা মাঝারি মাপের। বড়র মধ্যে। এবিপি আনন্দ আর ২৪ ঘণ্টা কোনদিন ডাকেনি। এই প্রথম ২৪ ঘণ্টা এগিয়ে এল তাই একটু আনন্দ একটু বিস্ময়। তবে কী ওরা এতদিনকার কট্টরতা থেকে সরে এল! অচ্ছুৎদের জন্য দরজাটা একটু খুলল!
প্রচার কে না চায়? হতে পারে অনেকে চায় না, আমি চাই। প্রচার না হলে আজ যে হারে আমার বই লোকে কিনছে–পড়ছে, সে কী সম্ভব হতো? আমি সেই ভাগ্যবাণের একজন যে টেলিভিশন পত্র পত্রিকা অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম সবার অকৃপণ সহযোগিতা পেয়েছি। ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই তারা আমাকে ব্যবহার করেছে, তবু তাদের সহযোগিতা না পেলে কে আমার নাম জানত–কে বা চিনত! আমার পাঠক, প্রকাশক আর সেই সাথে ওই সব সংবাদ মাধ্যম–সাংবাদিক অবশ্যই তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার কথা স্বীকার না করে কোন উপায় নেই।
দলিত সাহিত্য সংস্থার তেইশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে গেছি। এই সব লেখক কবিদের অনুষ্ঠানে খুব একটা যেতে চাই না। আমি লিখি তো সেই ৮১ সাল থেকে। বিদ্বান লোকদের কিছু ব্যঙ্গবিদ্রূপ জুটলেও তেমন তীব্রতম আক্রমণ আক্রোশের সামনে কখনও পড়িনি। সেই যে বছর মীনাক্ষী মুখার্জী আমার লেখা ইপি ডরু তে ছাপালেন আর সারা ভারতের কেউ কেউ আমার নামের আগে দলিত সাহিত্যিক বলে দেগে দেওয়া শুরু করল, বাঙালি দলিত সমাজের সেই সব লেখক যারা কেউ শিক্ষক কেউ কোন সরকারি বড় চাকুরে বহু বছর কলম ঘসেও যারা কোন সম্মান পুরস্কার স্বীকৃতি এখনও পাননি, নিজের জমানো টাকায় গাদা গাদা বই ছেপে গোছা গোছা বিলিয়েও রয়ে গেছে অপরিচয়ের অন্ধকারে, তারাই আমার সব থেকে বেশী বিরোধীতায় নেমে পড়ল। মনোরঞ্জন দলিত লেখক। লেখার কী জানে ও দলিতের সংজ্ঞা কী বোঝে! দলিত সাহিত্য কাকে বলে ধারণা আছে! ওকে তো ব্রাহ্মণ্যবাদীরা প্রচার দিয়ে উপরে তুলেছে। আসলে তো হাওয়া ভরা বেলুন, পেটে কোন বিদ্যে নেই।
দলিত বিশেষ করে নমঃশূদ্র সমাজের সেই সব মানুষ আমাকে গভীরভাবে ভালোবাসে, যারা পড়ে এবং ভাবে। যারা লেখে তারা ঈর্ষায় পোড়ে। তাই পারত পক্ষে আমি দলিত লেখকদের ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে চাই না। এটায় এই জন্য যেতে হল—এখানে আজ আমার পরিচিত একজন লোক আসবে। যার সঙ্গে দেখা করাটা খুবই দরকার এবং সে লেখক নয়, পাঠক।