এক নেতা মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ তো ঘোষণা করে দিলেন। তারপর এসে মেহমান হলেন ভারত দেশের। খান সেনা আর রাজাকারদের হাতে মুরগি ছাগলের মত মানুষ কাটা পড়ল। উনি রইলেন রণক্ষেত্র থেকে বহুদূরের নিরাপদ আশ্রয়ে। শেষে ভারত সরকার যুদ্ধ টুদ্ধ করে খানসেনাদের তাড়িয়ে দেশটা দখল করে উপঢৌকন দিল তাকে। তবে সেই পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা বেশী দিন ভোগ করা ভাগ্যে জুটল না। তিনি মানুষের বিপদে পাশে ছিলেন না, তার বিপদেও মানুষকে পাশে পেলেন না। কয়েক জন ঘাতক নির্বিবাদে গুলি চালিয়ে তাকে মেরে চলে গেল ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
আর এক নেতা সতীশ মণ্ডল। এ সেই নেতা যে রাম চ্যাটার্জীর সাথে দণ্ডকারণ্যের বাঙালি এলাকায় ঘুরে ঘুরে প্ররোচনা দিয়েছিল সবাইকে মরিচঝাঁপি আসার জন্য। এক লক্ষ মানুষ এসেছিল তার কথা শুনে। আর যেদিন বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ চল্লিশখানা লঞ্চ দিয়ে চারদিক থেকে দ্বীপকে ঘিরে ধরল, মধু মালাকারকে সাথে নিয়ে নদী সাঁতরে সবার আগে পালিয়ে গেলেন সতীশ মণ্ডল। মধু মালাকার এখন পারাল কোটে থাকে। সতীশ মণ্ডল রায়পুরে। এরা এসেছিল আবার ফিরে গেছে। খোঁজ নেই চার হাজার সাতশত আঠাশ জন মানুষের–কেউ জানে না তাদের কী পরিণতি হয়েছে।
এই লড়াইবিমুখ পলায়নি প্রবৃত্তি আমাদের রক্ত মাংস অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। তাই আমাদের বিষয়ে কেউ ভাবে না। মাত্র পঞ্চাশ লক্ষ গোখা যখন হুংকার দেয় গোখা ল্যান্ড চাই–পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার সব কেঁপে ওঠে। আমাদের ভয়ে কাঁপে না। ওরা জানে হীনধর্মী কাপুরুষ পলায়নী বাঙালি মনোবৃত্তির ধারক বাহক আমরা রাজনেতা গুরু গোঁসাই দেব দেবতার কাছে নত হতে হতে আমাদের শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। ধীরে ধীরে চতুষ্পদ হয়ে যাব। লোম গজাবে দেহে। লেজ গজাবে–তারপর একদিন আমরা ফিরে যাব সেই অবস্থায়–যেখান থেকে বানররা যাত্রা শুরু করেছিল মনুষ্যত্বের দিকে।
***
এটাই জগতের নিয়ম। যে আগাতে জানে না তাকে পিছিয়ে যেতে হয়। মাঝামাঝি কোন স্থান নেই। করিমগঞ্জ আসাম প্রদেশের অন্তর্গত হলেও বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশী। কেউ বলে না দিলে আমার পক্ষে এটা বোঝা সম্ভবই ছিল না যে এটা বাংলার অংশ নয়।
এই শহরের চারদিকে অনেকগুলো বড় বড় ব্যানার টাঙানো হয়েছে দেখলাম। সব ব্যানারে আঁকা আছে আমার মুখ। লেখা আছে আমি কে, আমি কী! আহ্বান করা হয়েছে মানুষকে, আসুন দেখে যান এক বিস্ময়কর মানুষকে।
এক সপ্তাহের অধিক সময় ধরে চলবে এদের নানাবিধ অনুষ্ঠান। গান আছে, নাচ আছে, নাটক আছে–একদিন রাখা আছে আমার জন্য। দু আড়াই ঘণ্টা যতক্ষণ লাগে বলতে বাঁধা নেই।
অনুষ্ঠান শুরুর দিন সকালে হাজার মানুষ হাতি নিয়ে এক বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা বের করে সারা শহর পরিক্রমা করেছিল। সেই শোভাযাত্রায় রঙ বেরঙের সাজ সজ্জায় মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। একদল ছেলে ছিল সামরিক পোষাকে। ব্যান্ডের তালে তালে কুচকাওয়াজ করছিল তারা।
সন্ধানী যুব সংঘ গঠিত হয়েছিল নিখোঁজ হয়ে যাওয়া প্রিয় নেতা সুভাষচন্দ্র বোসকে খুঁজে বের করার সংকল্প নিয়ে সেই পঞ্চাশের দশকে। যে যুবকেরা সেদিন সংঘ গড়ে ছিলেন অনেকে। মারা গেছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন সব বৃদ্ধ। সেই বৃদ্ধদের আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করার শপথ নিয়ে নব প্রজন্ম সংঘের কার্যভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
সন্ধানী যুব সংঘ নেতাজিকে খুঁজে পায় নি। পাবে কী না তা এখনও অজানা। তবে সেই উদ্দেশ্যে গঠিত সংঘ এখন সমাজ সেবামূলক বহু কর্মে করিমগঞ্জে একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। আর প্রতি বৎসর সাড়ম্বরে পালন করে থাকে নেতাজি জন্ম দিবস।
আজকের এই শোভা যাত্রায় আসামের বাঙালি অসমিয়া সবাই অংশ নিয়েছে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ছাপ-ছবি নিয়ে। কিছু মেয়ে ঐতিহ্যশালী পার্বত্য বেশবাসে তোক নৃত্যের তালে তালে পথ হাঁটছে। বাঙালি বধূরা লাল পাড় সাদা শাড়িতে চলেছে শঙ্খ বাজাতে বাজাতে। ঢাক তাশা আরও নানা ধরনের বাদ্য যন্ত্র বাজছে।
একদল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এসেছে স্কুলের পোষাক পরে। মিছিলের পুরো ভাগে তারা। হাতে স্কুলের নাম লেখা ব্যানার। উচ্ছল পাহাড়ি ঝর্ণার মত হেসে গেয়ে তারা পথ হাঁটছে।
আজ এই শহরের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সব নেমে এসেছে পথে! যারা মিছিলে হাঁটছে তারা তো হাঁটছে, যারা হাঁটতে পারছে না দুধারে দাঁড়িয়ে দেখছে বর্ণাঢ্য মিছিল।
একদল মেয়ে চলছিল ফুল ছড়াতে ছড়াতে। একদল শাঁখ বাজাচ্ছিল। বাজনার তালে তালে আসাম, বাংলার বিবিধ নৃত্য সহযোগে পথ হাঁটছিল লোক শিল্পীদের ছোট ছোট দল।
আসামের ‘আনন্দ বাজার’ যুগ শঙ্খ সাময়িক প্রসঙ্গ পত্রিকা পুরো এক পৃষ্ঠা জুড়ে আমার ছবি সহ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। আর সন্ধানী যুব সংঘ আমার বক্তৃতার সিডি করে বার বার প্রদর্শন করেছিল শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। এখানে আমার জন্য বাণীপ্রসন্ন মিশ্র তো বটেই, সন্ধানী যুব সংঘের সম্পাদক শ্যামলরঞ্জন দেব, রথীশ দেব নামে আরও দুজন মানুষকে পেয়েছিলাম, যাদের উষ্ণ হৃদ্যতা কোনদিন ভোলা যাবে না। পেয়েছিলাম দশ হাজার নগদ টাকা, একটা শাল একটা কম্বল, অনুর জন্য একটা শাড়ি ফুল মালা আর এক সমুদ্র ভালোবাসা।