আমরা এদেশে এসেছি সেই বাহান্ন তেপান্ন সালে। বাঁকুড়ার শিরোমণিপুর নামে যে ক্যাম্পে ছিলাম, তখন সরকার যে সব কাগজ পত্র দিয়েছিল–ডোল বন্ধ হয়ে যাবার পর যে দীর্ঘ সময় এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে সে সব কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি ছিল না–ছিল
কোন বাকসো তোরঙ্গ। ন্যাকড়ার পুঁটলিতে বেঁধে খড়ের চালার বাতায় গুঁজে রাখা সে কাগজ কবে যে পচে গলে গেছে তা কে জানে–।
সেই থেকে আমরা নাম পরিচয়হীন এক নেই দেশের নাগরিক। রেশন কার্ড, ভোটার লিস্টে নাম, জমির দলিল কিছুই ছিল না আমাদের। কুট রাজনীতির এক কলমের আঁচড়ে–আমাদের সব কিছু চলে গেছে।
নদীর নামটি সুরমা। ছোট যে নদী চিহ্নিত করেছে দু-দেশের সীমা। নদীর এপারে দাঁড়িয়ে এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে দেখছিলাম ওপারের ঘর বাড়ি মানুষজন। বার বার চোখে জল ভরে আসছিল। কয়েকটা বাচ্চা খেলা করছে। নদীতে কাপড় কাঁচছে, স্নান করছে কয়েকজন। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, চাইলে এক বুক জল সাঁতরে একমিনিটে পৌঁছে যেতে পারি ওপারে। আমার প্রিয় জন্মভূমিতে। সে মাটি নাকি স্বর্গের চেয়ে গরীয়সী। তবে যেতে দেবে না। রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে বসে থাকা বর্ডার সিকিউরিটির লোকেরা সাথে সাথে বুক মাথা সোজা গুলি চালিয়ে দেবে। এই সব পাহারাদারদের একজনও বাঙালি নয়। ওদের কোনদিন দেশ ভাগ হয় নি। দেশ ভাগের কী। যন্ত্রণা ওরা জানে না। জানে না স্বদেশের মাটি মানুষ গাছপালা পশু পাখির কী দুর্বার আকর্ষণ। তাই সেই আবেগ ওদের কাছে অবাস্তব অর্থহীন।
তবে কী ওরা কাউকে ওপারে যেতে দেয় না? আসতে দেয় না এপারে? দেয়। হাজার হাজার লোক আসা যাওয়া করে–সে রাতের আঁধারে ওদের সাথে নগদ লেনদেনের দরদাম চুক্তির ভিত্তিতে। আমি সে ভাবে যেতে চাই না। গিয়ে বা কী করব? ও দেশের মানুষের কাছে আমি যে বিধর্মী-মালাউন-কাফের-হিন্দু। ভাই বলে তারা তো গলা জড়াবে না। সে যদি জড়াত তাহলে তো দেশভাগই হতো না।
দেশ ভাগ কে করেছে, জিন্না না জওহরলাল–আমি সে তর্কে যাব না। তবে দেশ ভাগের ফলে ভারতবর্ষে কারা লাভবান হয়েছে তার কিছুটা বলতে পারি। প্রথম লাভ–সবচেয়ে বড় লাভ পেয়েছে–এ দেশের উচ্চবর্ণ সমাজ। তখন পূর্ববঙ্গের বরিশাল ফরিদপুর খুলনা যশোর জুড়ে হরিচাঁদ পুত্র গুরুচাঁদের নেতৃত্বে নমঃশূদ্রদের মধ্যে বিরাট একটা গণ জাগরণ দেখা দিয়েছে। যারা সবর্ণ সমাজের আধিপত্য ধর্মীয় শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নতুন ধর্মমত মতুয়া ধর্মের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ এক শক্তিশালী জনগোষ্ঠী হিসাবে সামনের সারিতে এগিয়ে আসছে। শিল্প সাহিত্য, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে জোর কদমে ধেয়ে যাচ্ছে।
এই অদ্ভুত অস্পৃশ্য নম জাতির অবিসংবাদী নেতা রূপে সামনের সারিতে চলে এসেছে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। যার সাথে যোগ সূত্র স্থাপিত হয়েছে মহারাষ্ট্রের মাহার নেতা বাবা সাহেব আম্বেদকরের।
তখন সারা ভারতে মহাত্মারূপে পূজিত জন নেতা উচ্চবর্ণ স্বার্থের সবচেয়ে বড় সংরক্ষক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে যার নাম জনচর্চার বিষয়–সে আম্বেদকর। গান্ধী নীতির প্রতি পদে যে তার শানিত যুক্তির অস্ত্র নিয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছে। আম্বেদকরকে সামনে রেখে সারা ভারতের মূক দলিত বঞ্চিত মানুষ মুখর হয়ে উঠেছে, দাবি জানাচ্ছে জন সংখ্যার অনুপাতে শাসনকর্মে ভাগীদারির।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নামে যে গালভরা গল্প পরিবেশন করা হয়–তা আসলে একটা মিথ্যের বাতাস ভরা বেলুন। কী সংগ্রাম হয়েছে। ক’টা লোক মারা গেছে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামে। হাতের আঙুলের কড় শেষ হবে না, শহীদের তালিকা শেষ হয়ে যাবে।
এত বড় একটা দেশ, যে দেশের জনসংখ্যা তেত্রিশ কোটি, যে দেশের মাটির তলে রয়েছে অপার খনিজ সম্পদ–মাটির উপর শস্যের অপার ভাড়ার। এমন স্বর্ণভূমি সে গোটা কয়েক লোকের ইংরেজ ভারত ছাড়ো শ্লোগান আর গুটি কয়েক আবেগ তাড়িত যুবকের খান কয়েক মশার পিস্তলের কুটুস কুটুস শুনে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল! এরোপ্লেন থেকে বোমা ফেলল না, কামানের গোলা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিল না–তেত্রিশ কোটির দশ কোটিকে লাশ বানিয়ে দিল না, এত শান্ত ভদ্র দয়ালু বৃটিশ সরকার। এই দয়া দিয়ে তারা সূর্য না ডোবা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিল!
আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ঝাড় খাবার পর নিজদেশ পূণর্গঠনের জন্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুশলি ইংরেজদের স্বদেশে ফিরে যাবার তাড়া ছিল। আফ্রিকার এমন দেশও আছে যারা ইংরেজ শাসকদের কাছে কাতর আবেদন করেছিল এখনই আমাদের ছেড়ে যেও না–কটা বছর সময় দাও। আমরা শাসন কার্য সঞ্চালনের মতো দক্ষ হয়ে উঠি তারপর যেও। তবু ইংরেজ শাসকরা সে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
এই একই কারণে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে। তবে অন্য দেশের ক্ষেত্রে যা করেনি–দেশটাকে টুকরো করে রেখে গেছে। চাইছিল এদেশের লোক–তারা সেটাকে কার্যকর করেছে মাত্র।
স্বাধীন দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে–সেই সংবিধান রচনার জন্য যে কমিটি উচ্চবর্ণ নেতৃবর্গ চায়নি ওই কমিটিতে আম্বেদকর জায়গা পাক! তাই তাকে গভীর এক ষড়যন্ত্র করে নির্বাচনে পরাজিত করে দেওয়া হয়। তখন বড় গর্বভরে উচ্চবর্ণ এক নেতা বলেছিলেন দরজা তো দূর আম্বেদকরের জন্য সংবিধান সভায় অনুপ্রবেশের জানলা পর্যন্ত আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।