মুম্বাইয়ের অনুষ্ঠানের পর সেই দিনই চেপে বসেছিলাম এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে আর দমদমে নেমে এক ঘণ্টা পরে ফের চড়ে বসেছিলাম শিলচরগামী আর এক প্লেনে। সন্ধানী যুব সংঘের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে করিমগঞ্জ যাবার জন্য আমাকে কলকাতা থেকে সাথে করে নিয়ে যাবার জন্য শিলচর থেকে কলকাতায় উড়ে এসেছিলেন করিমগঞ্জের সুযোগ্য সন্তান শিক্ষাবিদ বাণীপ্রস। মিশ্র মহাশয়। উনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত।
বক্তৃতা তো আমার সব জায়গায় প্রায় এক–আমার জীবন, আমার সাহিত্য। অন্য আর কী বলব! সেসব কথা বলার জন্য তো অন্য অনেক লোক আছে। থাকে না তেমন লোক, যে সমাজের সবচেয়ে নীচের ধাপের মানুষের যাপিত জীবনের রক্ত ঘাম চোখের জলের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে। সে সব বলতে হলে তো জানতে হবে। জানতে হলে তো যেতে হবে সেই সব মানুষের কাছে। মিলতে হবে মিশতে হবে–তাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে সেটা পেরে ওঠে না।
আমি সেই কথা বলি। যে সমাজের আমি-। যে সমাজ আমার। আমি আমার ব্যক্তি জীবনের অসহ্য অকথ্য অবস্থা আর সমাজ জীবনের চরম অবহেলা অবমাননার আখ্যান মানুষকে শোনাই। শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে হৃদয়হীন শাসন আর শোষণের নগ্নরূপ তুলে ধরি। বিষ বাক্যে বিদ্ধ করি বর্ণবাদ আর পুঁজিবাদকে।
এই সব সোজা সাপটা কথা শোনার জন্য মানুষজন আমাকে বহু ব্যয় করে দেশের নানা প্রান্তে নিয়ে যায়। আমার বাবা সেই মানুষ যার গায়ে একটা জামা, পায়ে এক জোড়া চপ্পল, পেটে ভাত, মাথায় এক ফোঁটা তেল ছিল না। জীবনে কোনদিন তৃতীয় শ্রেণির ট্রেনের একটা টিকিট কেটে নির্ভয়ে রেল সফর করতে পারেননি। সেই বাপের ছেলে–আমাকে উদ্যোক্তারা নিয়ে যায় এরোপ্লেনে-। ট্রেন হলে প্রথম শ্রেণির শীততাপনিয়ন্ত্রিত কামরায়।
আমি বিভিন্ন শহরে যাই বটে তবে সে শহরকে যে একটু ঘুরে দেখব তেমন সময় সুযোগ পাওয়া যায় না। এয়ারপোর্ট থেকে স্টেশন থেকে উদ্যোক্তারা গাড়ি করে তুলে নিয়ে গিয়ে পুরে দেয় পাঁচতলা দশতলা কোন হোটেলের সুসজ্জিত কক্ষে। সেখান থেকে বের করে নিয়ে যায় অনুষ্ঠান মঞ্চে। মঞ্চ থেকে নামলে আবার হোটেলে। হোটেল থেকে বের করে সোজা স্টেশন না হয় এয়ারপোর্ট। দরকারের বাইরে আর এক মিনিটও সময় দেবে না। সময় এখানে খুবই মূল্যবান। শুনি-এখানকার একদিনের থাকা খাওয়ার হোটেল বিল নাকি আমার মত মানুষের এক মাসের মাইনেও ছাড়িয়ে যায়।
তবে এবার ইলিনা দিদি আমাকে মুম্বাই ঘুরে দেখার জন্য একটু ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গাড়ি ড্রাইভার আর আমার গাইড হিসাবে সাথে পাঠিয়েছিলেন নিজের মেয়েকে। গেট ওয়ে অব ইন্ডিয়া, খাজা বাবার মাজার, লতা মঙ্গেশকরের বাড়ি-আরও অনেক কিছু দেখে নিতে পেরেছিলাম দিদির দয়ায়।
রূপ নগরী মুম্বাই। যে মুম্বাইকে আমরা জানি সিনেমার কল্যাণে অর্থ যশ ভোগ বিলাসের স্বর্গভূমি হিসাবে-কত যে যুবক যুবতী এই শহরের মোহ মদির আকর্ষণে পাগলের মত ছুটে এসে–জীবনের অনেক অমূল্য সময়ের অপচয় করে হতাশ-ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে যায় তার কোন গোনাগাঁথা নেই।
ফেরার দিন মনে হয় রাত আটটায় প্লেনে চেপেছিলাম। দশটা সাড়ে দশটায় দমদমে নামবার কথা ছিল। কথা ছিল–আড়াই নাম্বার গেটে বন্ধু রাজু দাসের বাড়ি রাতটা কাটিয়ে পরের দিন বেলা একটায় শিলচরগামী প্লেনে উঠব। সে আর হল না। প্লেন অধিক কুয়াশার কারণে দমদমে নামতে পারল না। ঘুরিয়ে নাগপুরে নিয়ে চলে গেল। সারারাত সে কী কষ্ট। একে তো প্রবল শীত তার উপর না জল, না খাবার।
পরের দিন আটটায় নাগপুর থেকে ছাড়ল প্লেন। দমদমে পৌঁছাল দশটায়। তখন হাতে মাত্র এক ঘণ্টা সময়। এগারোটায় তো আবার রিপোর্টিং করতে হবে। বাণীপ্রসন্নবাবু তো শিলচর থেকে দুদিন আগে এসে বসে আছেন আমাকে নিয়ে যাবেন বলে। সকালে বাড়ি থেকে আমার স্ত্রীও এসে গেছে, এসেছে আমার পরম মিত্র অনন্ত আচার্য আর বন্ধু রাজু দাস। তার হাতে টিফিনক্যারিয়ার। তাতে খাদ্যদ্রব্য বোঝাই।
এয়ার পোর্টে বসে সেগুলোর সদগতি করতে হল। তারপর রওনা দিলাম শিলচরের দিকে।
এখন আমি বেশ সড় গড় হয়ে গেছি। অনেক সাবলীল অনেক স্বচ্ছন্দ। এই নিয়ে সাতবার হচ্ছে প্লেন যাত্রা। এখন আমি সিট বেল্ট কেমন করে বাঁধতে হয় জানি। কেমন ভাবে পাথর পাথর মুখ করে চারদিকে তাকাতে হয় পারি। একজন সৌদি আরব থেকে ফেরা যাত্রী মোবাইল চালাচ্ছিল, তাকে ধমকে সেটা বন্ধ করিয়ে দিই।
সাতদিন ছিল এবারের ভ্রমণ। সত্যি বলতে কী অনেক মর্যাদাময় অনুষ্ঠানে অনেকবার অতিথি তত হয়েছি, কিন্তু শিলচর করিমগঞ্জ-সুপ্রাকান্দি এই সব জায়গার ছোট বড় প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে যে অকৃত্রিম আন্তরিকতা দেখেছি–তা আমার পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। এক দাদা তার গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ বর্ডার দেখাতে। এপারে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম ওপার আমার সেই জন্মভূমি। সেখান থেকে চলে তো এসেছি সেই শিশুবেলায় আর কোনোদিন যেতে পারিনি। যেতে আর পারব না। আমার যে পাসপোর্ট ভিসা নেই। সে সব পেতে হলে যে সব কাগজ পত্র লাগে তা আমার কাছে নেই।
আমার বাবা ছিলেন লেখাপড়া না জানা মানুষ। কোন কোন কাগজ বানিয়ে রাখতে হয়, গুছিয়ে রাখতে হয় যে সব কাগজের জোরে নিজেকে ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করা যায় তা তিনি জানতেন না।