একটা জাতি–এপার ওপার বাংলা মিলিয়ে যাদের জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটির কাছাকাছি। সমাজের বহু ক্ষেত্রে তাদের বিশিষ্ট অবদান থাকলেও এই একটি ক্ষেত্র–সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা ছিল না। হতে পারে এতে কোনো অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হবার সম্ভাবনা না থাকায় শিক্ষিত নমোরা এদিকে আগ্রহ দেখায়নি। এত কষ্ট করে লেখাপড়া যখন শিখলাম–যাতে দুটো পয়সা পাওয়া যায় বিদ্যে বুদ্ধি সেই কাজে লাগাই। এই হয়তো তাদের মনোভাব। তবে এটাও একান্ত ব্যক্তির মনোভাব। সমাজের অন্দরে কিন্তু ওই শূন্যস্থান পূরণের একটা আর্তি অনুভূত হচ্ছিল। অনুপস্থিতির অভাবটা ব্যথা দিচ্ছিল।
ভারতবর্ষের সবচেয়ে অভাগা যারা বাংলা ভাষায় লেখালেখি করেন। এখানে যে যত বড় লেখকই হোন, বর্তমান সময়ে শুধু লিখেই সংসার চালাতে পারেন না। প্রত্যেককে কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো চাকরি করতে হয়। এখানে যে কত শত পত্র পত্রিকা বের হয় গুনে বলা মুশকিল। পত্রিকার কর্মকর্তারা কাগজের দাম দেন, কম্পোজিটার, প্রুফ রিডার, বাইন্ডার, পুস্তক বিক্রেতা সবারই পারিশ্রমিক দিতে বাধ্য থাকেন। শুধু বেচারা লেখকের বেলায় কাঁদতে বসেন, আমরা ক্ষুদ্র পত্রিকা, বড় গরিব ইত্যাদি।
এই কারণে বিশেষ করে বুদ্ধিমান শিক্ষিতরা ঘরের খেয়ে সাহিত্যের মোষ তাড়াতে মনের সায় পায়নি।
প্রায়শই একটা অভিযোগ ওঠে যে দলিত লেখকের লেখা নাকি উচ্চবর্ণদের পত্রিকায় ছাপতে চায় না। ধরে নিলাম যে দলিত লেখকদের লেখায় সেই সাহিত্য গুণমান রয়েছে তবু সেই বৈষম্য। তাহলে দলিতদের দ্বারা প্রকাশিত দলিত জীবন নিয়ে লিখিত দলিত লেখকেও ন্যূনতম সম্মান দক্ষিণা থেকে বঞ্চিত করা হয় কেন?
কারণটা ওই–বাংলা ভাষার লেখকরা বড় হতভাগ্য।
আমি লেখক ছিলাম না। একটু পড়তে লিখতে শিখে সেই শিক্ষা দিয়ে আর কিছু করা যায় না বলেই সাদা কাগজকে কালিমালিপ্ত করার খেলায় মেতে উঠেছিলাম। সেই যে বলে না, খেলতে খেলতে খেলোয়াড়, জানতে জানতে কী যেন–তো লিখতে লিখতে লেখক হয়ে গেছি। এখন, কেউ আমাকে বলে দলিত লেখক, কেউ বলে প্রতিবাদী লেখক, কেউ বলে প্রগতিশীল লেখক, এক পত্রিকা লিখেছে শ্রম সংস্কৃতির প্রতিনিধি। এইসব অভিধায় অভিহিত হবার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকায় রয়েছে আমার বই ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন। এতে সাহিত্য কতটা আছে সে বিচারের ভার যারা সাহিত্য বোদ্ধা তাদের। তবে মানুষ একে কিছু ভালোবাসা দিয়েছে। যার জন্য মিলেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির স্বীকৃতি।
আর সাধারণ, স্বল্প শিক্ষিত, নমঃশূদ্র মানুষদের আদর ভালোবাসা। এবার তাদের মধ্যে তারা একজন লেখক পেয়েছে, যাকে উচ্চবর্ণ সমাজও সম্মাননা দেয়।
***
এবার ডাক এসেছে আমার লক্ষ্ণৌ শহরে এক অনুষ্ঠানে যাবার। দৈনিক জাগরণ পত্রিকা কয়েক মাস আগে বিহার সরকারের নবরস সংস্থা দ্বারা আয়োজিত বিহার দিবস অনুষ্ঠানের এক অংশীদার হয়েছিল। আমি সেই অনুষ্ঠানের একজন আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। তারা তখন দেখেছে আমাকে। শুনেছে আমার কথা। এইবার এটা তাদের নিজস্ব অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে চায় আমাকে। আমার মুখেই–আমার অবমাননাকর জীবনের কথা শোনাতে চায় লক্ষৌবাসিদের–।
এই সেই লক্ষ্ণৌ। সাতচল্লিশ বছর আগে আর একবার এসেছিলাম এই শহরে। লোকো-রেলের ইঞ্জিন মেরামতির কারখানায় মাসে মাত্র পঞ্চাশ টাকা মাইনেয় এখানে কাজ করতাম। রেল লাইন থেকে ঝুড়ি ভরে ছাই সরাবার কাজ ছিল আমার। সেই দিনে এখান থেকে চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়ে অভিশাপ দিতে দিতে ফিরে গিয়েছিলাম আমি–।
আজ সেই শহর, সেই ছাই ফেলা তুচ্ছ মজুরকে দিচ্ছে এক মর্যাদাময় মঞ্চ। অসংখ্য ক্যামেরায় ফ্লাশ বাশ্বের আলো ঝলসে দেবে তার মুখ। প্রভাতি সংবাদ পত্রের পাতায় থাকবে তার ছবি–খবর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রেষ্ঠ গুণীজন আজ নিশ্চল বসে শুনবে তার কথা।
ঐতিহাসিক কাল খণ্ডে–এটা বার বার দেখা গেছে যে, সময়ের প্রয়োজনে মূক মানবও মুখর হয়ে ওঠে। চির পরাজিত অথব–অশক্তও উঠে দাঁড়ায়। প্রত্যাঘাত করবার জন্য। আজ আমার কাঁধে সেই দায়িত্ব এসে পড়েছে। দলিত-দরিদ্র শ্রমজীবী জনতার সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে আমি এসেছি ভদ্রবাবুদের জমায়েতে আমাদের প্রতি অন্যায় অবিচারের কথা তুলে ধরতে। প্রতিকার চাইতে। সাবধান করে দিতে। সামলে যাও তোমরা। মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা এবং মজুরি দাও। এখনও সময় আছে। তা না হলে মানুষের মনে হাজার বছর ধরে জমে থাকা ক্রোধের বারুদে যদি বিস্ফোরণ ঘটে শাসন শোষণের দাম্ভিক দুর্গ ধুলো হয়ে খুঁড়িয়ে যাবে।
না, আমাকে কেউ এই দায়িত্ব সমপর্ণ করেনি। গণভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেনি কেউ। আমি স্বেচ্ছায় এই দায় ঘাড়ে নিয়েছি এবং আমৃত্যু বহন করে চলব।
এর আগে মুম্বাই ঘুরে এসেছি কদিন আগে। স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ বিনায়ক সেনের সহধর্মিনী ডঃ ইলিনা সেন।–যিনি টাটা সোশ্যাল সায়েন্সের একজন সম্মানীয়া অধ্যাপিকা।ইলিনা দিদির আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম মুম্বাই। সেই সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠানের এক অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তা ছিলাম আমি। ওই মঞ্চে আর যত বক্তা ছিলেন সবাই বক্তব্য রেখেছেন ইংরাজিতে। একমাত্র আমারটা পরিবেশন করেছিলাম রাষ্ট্র ভাষা হিন্দিতে। শ্রোতার আসনে দিল্লি কলকাতা মুম্বাই ভুবনেশ্বর এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক তো ছিলেনই–তবে আমার কাছে যাঁর উপস্থিতি সবচেয়ে বড় তিনি ডঃ বিনায়ক সেন।