কি লেখা আছে সেই মানপত্রে এখানে তুলে দেবার ইচ্ছা দমন করা যাচ্ছে না। তাই তুলে দিলাম–
বিশিষ্ট দলিত সাহিত্য কর্মী মনোরঞ্জন ব্যাপারী মহাশয়ের প্রতি
সুধি,
ঝলমলে চটকদার বিশ্বায়নের শৌখিন পৃথিবীতে এক বিচিত্র জীবনের দুর্লভ আখ্যান নিয়ে সচল ও বহতা আপনার জীবন। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক অভিমানের। তথাপি আমাদের জ্ঞান নারী অভিজ্ঞতা হেমন্তের হলুদ ফসল–এসবই আপনার সৃজনশীল চেতনায় ক্রমশ অন্বিষ্ট। প্রকৃত প্রস্তাবে মেধাবী সৌন্দর্যের একজন কঠিন মানুষ আপনি, যে মানব-জমিনে আকীর্ণ রয়েছে অপরাজেয় মানবশক্তির উষ্ণ অভিজ্ঞান।
শ্রেণি শোষণ ও বর্ণবাদের তিক্ত লেনদেন নিয়ে গড়ে ওঠা অতলস্পর্শী সংস্কার ও অনড় সমাজের আঘাতে বিক্ষত হলেও সৃজনে মগ্ন ছিল আপনার কলম। পূর্ববঙ্গ, ছত্তিশগড়, মুকুন্দপুর হয়ে আজকের সারস্বত সমাজ; ক্ষয়া ইটের প্রতিটি সিঁড়ি আপনাকে পেরোতে হয়েছে থমথমে দুঃ। খের মতো সন্ধ্যা বুকে নিয়ে। তবু ফসলের স্বর্ণ-শস্য হাতে নিয়ে সমৃদ্ধ ও সম্পন্ন করেছেন আমাদের সাহিত্য চেতনাকে।
‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন’–সেইখানে প্রতিবন্ধকতার সেই প্রান্তিকতায় আপনারও অবস্থান ছিল। নিম্নবর্গীয় লোকায়ত জীবনের ব্যাথার্ত সত্য বুকে নিয়ে আপনি যেন আমাদের পরম আত্মীয়। মাল্টিপল চয়েসের এই প্রগলভ সমাজে আপনার সঙ্গে তাই ভাগ করে নিতে চাই আমাদের দুঃখ-বেদনা। আমাদেরই সংগঠনের উদ্যোগে গড়ে ওঠা, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন বিদ্যালয়-এর ছাত্রাবাস কর্মী হিসাবে আপনার পেশাগত জীবন; আর সাহিত্যাঙ্গনে আপনি আমাদের শিক্ষক।
আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের এই মহতী লগ্নে আপনাকে সম্মাননা জ্ঞাপন করতে পেরে আমরা গর্বিত। আশা করে থাকবো, বৈদ্যুতিন কৃৎকৌশলের এই অবিশ্বাস্য পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে আপনার জীবনের দুর্লভ কাহিনি, ক্রমশ বহতা হবে আপনার লেখনি ভিন্নতর বাস্তবতার বর্ণিল প্রকাশে।
.
আমাদের এই সম্মাননা গ্রহণ করে সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন নিয়ে আপনি এগিয়ে চলুন সৃষ্টির বিচিত্র পথে, গ্রহণ করুন আমাদের অন্তরের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
আমি আর কোনো মন্তব্য করব না। শুধু শেষ কথাটা বলে লেখায় ইতি টানব।
এত কিছুর পরেও–দু’বেলা দহন হচ্ছি আজও–দুমুঠো অন্নের জন্য। প্রবল গ্রীষ্মের দাবদাহেও আমার চারপাশে জ্বলে চারখানা অগ্নিকুণ্ড। দুবেলা রান্না করি আড়াই থেকে তিনশত জনের। কাজ দিন থেকে কেড়ে নেয় দশ বারো ঘণ্টা। এই দেশ এই সময়, এই সমাজ আমাকে আজও দেয়নি দুমুঠো ভাত আর পড়া লেখার সামান্যতম সুযোগ।
আমার অপরাধ আমি যে দলিত। শম্বুক একলব্যর গোত্র। এই অপরাধ বর্ণবাদী ব্যবস্থায় ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
ওরা যখন নিজেদের বদলাবে না, আমাদের কলম কামানের নলের মতো চলছে চলবে। এ যুদ্ধ থামবে না।
***
অবশেষে–বলা চলে, বৃত্তটা সম্পূর্ণ হলো। যদিও সময়টা একটু বেশিই লেগে গেল, সে আর কী করা যাবে। তবে ওই, হলো তো। এটা না হলে আমার তো বটেই, মনুষ্য সমাজের বহু মানুষের সেই বদ্ধমূল বিশ্বাসটারই অপমৃত্যু ঘটে যাবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল, যে বিশ্বাসের মূল ছিল–লেগে পড়ে থাকলে–একদিন না একদিন অবশ্যই বিজয় করতলগত হয়, সাফল্য আসে। তখন মানুষ আমাকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করে প্রশ্ন করার সুযোগ পেত–ওইযে লোকটা কী কঠোর পরিশ্রমটাই না করেছিল, কিন্তু কী তার হলো! কী পেল?
এটা ঠিক যে কাল আমি যা ছিলাম ব্যক্তি জীবনে আমি আজও তাই আছি, তবে সমাজ জীবনের অঙ্গ হিসাবে ব্যক্তি জীবনটা আর হেলাফেলার বিষয় নেই, অনেক গর্ব অহংকারের অলঙ্কার হয়ে গেছে। বহু মানুষের বুকটা ফুলে উঠেছে, মাথাটা উঁচু হবার হিম্মত পেয়েছে।
আমি তখন ছিলাম মেরঠে। এক বন্ধু স্থানীয় ডাক্তারের বাড়িতে। গৌতম বিশ্বাস নামে এই ডাক্তার চাঁদসী চিকিৎসক। এখানে বলা রাখা দরকার চাঁদসী চিকিৎসা নামে অর্শ, ভগন্দর, নালী ঘা–এই সব রোগের চিকিৎসার আবিষ্কারক এই নমো সমাজেরই মানুষেরা। যে রোগী সর্বত্র বিফল সেইসব হতাশ রোগীদের ডাক্তার গৌতম বিশ্বাস গ্যারান্টি দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিরাময় করে থাকেন। তখনই পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সচিব শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ফোনে আমাকে জানালেন–“এই বছরের বাংলা আকাদেমির সুপ্রভা মজুমদার স্মারক পুরস্কারের জন্য আপনাকে নির্বাচন করা হয়েছে।”
সেই যেবার নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গিয়েছিলেন বিশ্বের মানব জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম যে কথাটি বলেছিলেন তা হল–আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে এটা একটা ছোট্ট পদক্ষেপ কিন্তু সমগ্র মানব জাতির পক্ষে এটা একটা বৃহৎ উলম্ফন।
১১ই জানুয়ারি ২০১৪ তারিখ সন্ধেবেলায় বাংলা আকাদেমি মুক্তমঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরস্কারটা হাত পেতে নিতে নিতে আমারও ঠিক ওই রকমটা মনে হচ্ছিল। পুরস্কারের অর্থমূল্য মাত্র পঁচিশ হাজার। তেত্রিশ চৌত্রিশ বছরের অক্লান্ত কমপেশার পক্ষে মূল্যটা বড় কম। কিন্তু সামাজিক সম্মাননার ক্ষেত্রে এর মূল্য অপরিসীম। এই সম্মাননা এসেছে তার হাতে যে কোনোদিন কোনো স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোতে পারেনি।
পুরস্কার ফলকটা আমার হাতে তুলে দিলেন মাননীয় উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু আর বাংলা অকাঁদেমির সভাপতি মাননীয়া শাঁওলী মিত্র। হ্যাঁ দুজনেই অর্পণ করলেন সেই মহার্ঘ্য সম্মাননা। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ষাট লক্ষ নমঃশূদ্র মানুষের মধ্যে আমিই সেই যে বঙ্গসাহিত্যে সর্বপ্রথম এই পুরস্কার পেল। এটা সমগ্র দলিত অবহেলিত নিরন্ন নমঃশূদ্র সমাজের পক্ষে বিরাট একটা সাফল্য।