শুধু একটি ক্ষেত্রে এতকাল পিছিয়ে ছিল এই সমাজ। তাদের কোনো লেখক ছিল না, যে উচ্চবর্ণ সমাজের সঙ্গে সমানে টক্কর দেবে। যে দু-একজন আছে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে না পেরে গুটিয়ে আছে রিকেট রোগী সদৃশ্য দু-একটি দলিত পত্রিকার পাতায়। বাধ্য হয়ে নমঃশূদ্র সমাজ–মালো সম্প্রদায়ের লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণকে আমাদের লোক বলে চালাচ্ছিল এতকাল ধরে। সেই শূন্যতা কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে দিয়ে। যার লেখা ছাপা হয় উচ্চবর্ণদের কাগজে। যে লেখে নিম্নবর্ণ মানুষের জীবন নিয়ে। এবং সে জাতিতে খাঁটি নমোশূদ্র।
দলিত সমাজের এক নেতা সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস মৌলালি যুবকেন্দ্রে এক অনুষ্ঠান হলভর্তি দলিত মানুষের সামনে ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বইখানাকে পড়তে উপদেশ দিয়েছেন রবীন্দ্র সাহিত্যেরও আগে। জামশেদপুরের চিত্র পরিচালক বিদ্যার্থী চ্যাটার্জী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন–দলিত জীবন তার সংগ্রাম সম্যক জানতে বুঝতে হলে একটা সিনেমা–জয় ভীম কমরেড দেখা দরকার, পড়া দরকার ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন। আর দলিত দরদী অনন্ত আচার্য–সে তো বিভিন্ন দলিত শ্রমিক সংগঠনে বইখানাকে নিয়ে গিয়ে নমাজের শেষে মুসলমান মৌলবী যেভাবে কোরান পাঠ করে নিরক্ষর মানুষকে শোনায়–সে পাঁচ দশ পাতা পড়ে শোনায়–আলোচনা করে।
আজকাল সিপিএম সচেষ্ট হয়েছে দলিত, নমঃশুদ্র, মতুয়াদের তৃণমূল শিবির থেকে টেনে নিজেদের দিকে নিয়ে আসার, যারা বহুকাল দলন-দমন সয়ে সিপিএমের সাথেই ছিল। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে গত ২০১১ সালে। সেই সিপিএমের কমরেডদের কাছে আজ আর অজানা থাকার কথা নয়, নমঃশূদ্রদের কাছে মনোরঞ্জন কতটা প্রিয়, কতটা আপন। একে নিজেদের গোয়ালে ঢোকাতে পারলে–কিছুটা ড্যামেজ কন্ট্রোল তো হয়ই। সেই চাতুরির অঙ্গ এই সম্মান প্রদর্শন। একে মঞ্চে বসিয়ে আমাদের লোক’বলে চালিয়ে দিতে পারলে অনেকটা কাজ সারা হয়ে যায়। যদিআর কিছু নাও হয় বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায় একে এর আপন জনের কাছ থেকে।
উত্তর চব্বিশ পরগণার বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে আমাকে আদর করে নিয়ে গেছে–আমার আপনজনেরা। সেখানে কী বলেছি কী করেছি সূত্র মারফৎ জেনে গেছে যাদের জানার। একদিন তো শিয়ালদহে আমাকে সচেক্ষ দেখে ফেলে সদলবলে এক সিপিএম রাজ্য কমিটির নেতা। তাই এখন এই সব চাতুরি।
এইরকম অবস্থায় যখন হাড়িকাঠে গলা না দেবার পণ করে বসে আছি একটা চিঠি এল আমার নামে। পাঠিয়েছে বড় সাহেবের সই করা সেই চিঠি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী। অনেক কথার মধ্যে লেখা আছে–৩রা ডিসেম্বর ২০১২ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে আপনার সাহিত্য কর্মের জন্য সংবর্ধনা জ্ঞাপন করতে চাই। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ মাননীয় সোমনাথ চ্যাটার্জী মহাশয়। আপনি এই আমন্ত্রণ স্বীকার করে আমাদের গৌরবান্বিত করুন। এখন আমি কী যে করি! রাজার অনুরোধও আদেশ হয়ে যায়। রাজাদেশ না মানার কী ফল সে জানে ভুক্তভোগী। যদি মুখের কথায় ব্যাপারটা মিটে যেত, সমস্যা ছিল না। এখন চিঠি চাপাটি চলছে। যাবো অথবা যাব না জবাব দিতে হবে লিখে। যদি ৩ তারিখ না যাই পরের দিনই সামনা সামনি হতে হবে রাজক্রোধের। ভেবেছিলাম আরও ছয় মাস কী এক বছর টিকে যাব, এক মাস কী ছয় সপ্তাহও টিকতে দেবে না। ওরা অনেক–আমি একেবারে একা। কী করে পারব?
অবশেষে বলি বড় সাহেবের ডান হাতকে–ঠিক আছে আমি যাব। তবে যদি দেখি আমাকে মঞ্চে বসিয়ে গাদা গাদা অসত্য তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে আমি কিন্তু সাথে সাথে ওখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করব। যা সত্য সেটাই প্রকাশ করে দেব। তারপর যা হয় হবে।
বলে সে–আপনি এখানে রান্না করেন সেটা তো বলা যাবে নাকি?
বলা যাবে। তবে এই নয় যে রান্না করতে করতে লেখক হয়েছে। আমরা সব রকম সাহায্য করেছি। সেটা যদি বলে আমি বলব–ভুল। আমি একাশি সাল থেকেই লিখি। ২০.১১.৮১-তে যুগান্তর পত্রিকা আমাকে লেখক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। স্কুলে কাজে আসি ৯৭ সালে। তার আগেই আমার একটা লেখা প্রতিক্ষণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যেটা পরে ইংরাজিতে অনুবাদ হয়ে ফ্রন্টিয়ারে আর হিন্দিতে অনুবাদ হয়ে রাজকমল প্রকাশনার বই ‘সংঘর্ষ আউর নির্মাণ’-এ ছাপা হয়। কাজেই রান্না করে লেখক হয়েছি সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যেটা সবাই প্রচার চালায়। সত্যি এটাই যে, এই ইসকুল এক লেখককে দিয়ে বাসন মাজাচ্ছে, রান্না করাচ্ছে।
মনের মধ্যে জমে থাকা বহুদিনের বিষ একদমে ঝেড়ে দিয়ে থেকে দেখি ‘ডান হাতে’র মুখে আষাঢ়ের মেঘ জমে গেছে। তখন মনটা যেন অনেকটা নির্ভার হয়ে গেল।
কিছু লিখে দিইনি, মুখে বলেছি যাব। তাই গেলাম রাণী রাসমণি রোডে। এক জাউল্যার মাইয়ার’ নামাঙ্কিত রাজপথের অনুষ্ঠানে। আশা ছিল–হয়তো আমাকে মঞ্চে তুলবে না। না তুললে বেঁচে যাই। আমি গিয়ে মঞ্চের পিছনে যেন আত্মগোপন করে বসে রইলাম। কান রইল মাইকের শব্দের দিকে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সেই লোক যে বাহাত্তর সালে বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে এখন এক নেতা। মঞ্চে বসে আছেন সোমনাথ চ্যাটার্জী সহ আরও অনেকে, আমাদের বড় সাহেব তো আছেনই।
বহু সময় পরে আমার ডাক এল। মঞ্চে ওঠার সাথে সাথে আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল এক গোছা ফুল, একখানা মানপত্র আর একটা খাম। খামে একটা চেক। বলা হল–মনোরঞ্জন ব্যাপারী এক দলিত সাহিত্যিক যে আমাদের এক স্কুলে বাচ্চাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে ‘একটু সহযোগ’ দিয়ে থাকেন। দাঁড়ালাম ততক্ষণ যতক্ষণ মানপত্রটা পড়া হল। তারপর ওরা নামার পথ দেখিয়ে দিলে আমি নেমে এসেছিলাম। কিছু বলার মতো সুযোগ দিল না, কিছু বললে শোনার মতো লোকও সেখানে ছিল না। অর্ধেক বোবা বধিক অর্ধেক নিজের কষ্টে কাতর অন্ধ পঙ্গু বিকলাঙ্গ। তবে সুযোগ করে মাননীয় সোমনাথ চ্যাটার্জীর হাতে পাঁচখানা পেপার কার্টিং ধরিয়ে দিতে পেরেছিলাম। এই যে আমি। তাতেও কোন ফলপ্রসব করেনি।