আর তাই রেহাই নেই পায়ের। সে দিনে দিনে কাহিল হয়ে যাচ্ছে। চলছে একেবারে অন্তিম অবস্থা। আর মেরে কেটে পেন কিলার চার্জ করে ছয় মাস। বড় জোর এক বছর। তারপর বসে যেতে হবে। বিল্টুদায় নিতে হবে কর্মভূমি থেকে। তাহা হইলেই সপ্তদশ রথীর মনোস্কামনা সিদ্ধ হয়।
আমি কবি নই তাই বলতে পারব না, যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো। আমি এক রাঁধুনি। হাজার পাতা লেখার পরেও লেখক হয়ে উঠতে পারিনি। আমার জন্য আছে পল্লী কবির দু-কলি গান–গুরু ভজলি নারে মন, বুঝলি নারে বাঁচাবে কে যখন এসে দাঁড়াবে শমন।
শৈলেনবাবু চলে যাবার পর প্রতিবন্ধী সংগঠনের জনে জনে তিন চারদিন ধরে ক্রমান্বয়ে আমাকে বুঝিয়ে চলল, তারা যে উদ্দেশ্যে যে কাজটা করতে চাইছে সেটা সফল করতে আমার সামান্য উপস্থিতি কতটা সঠিক। যা না করা, বলা চলে–একটা নিমক হারামির মতো ব্যাপার।
দীর্ঘ তিন দশক ধরে প্রবল এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ক্রোধ আর জেদ সম্বল করে অনলস প্রয়াসে আমি আজ যেখানে এসে পৌঁছেছি সে স্থানটা বড় আদরের অহঙ্কারের। এটা একা আমার নয়–গোটা নমঃশূদ্র জাতির গর্ব অহঙ্কার। আমি আজ আমার সমাজের সম্পদ, তাদের আদর আর ভালোবাসার ধন।
মার্কসবাদ পড়ে জেনেছি ঐক্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে, থাকে দ্বন্দ্বের মধ্যে ঐক্য। যেমনভাবে সর্বহারা মানুষদের ছোট ছোট প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, আছে বৃহত্তর স্বার্থে ব্যাপক জনগণের ঐক্য। একে অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই।
সেই রকম বৃহত্তম ভারতীয় দলিত সমাজ-সংগঠনেও ছোট ছোট দ্বন্দ্ব বা গর্ব-হীনমন্যতা রয়ে গেছে, যাকে গভীর নিরীক্ষণে ধরতে পারা যায়। অস্বীকার করা যায় গাজোয়ারি যুক্তি দিয়ে।
আমরা বলে থাকি বাঙালি জাতি আজ যা ভাবে কাল তা ভাবে সারা ভারতবর্ষ। আজ যা করে কাল করে সারা দেশ। এই কথা বুক বাজিয়ে বলতে গিয়ে বাঙালি দলিত সমাজ দেখে–যে, মহারাষ্ট্রে একজন আম্বেদকর আছে, উত্তর প্রদেশে কাশীরাম মায়াবতী আছে, আমাদের তেমন কেউ নেই। তারা যা বলছে, যে পথে আজ চলেছে, আমরা আশা করছি কাল বা পরশু সেই পথে হেঁটেই সারা ভারতে শূদ্ররাজ আসবে। তাহলে আমরা যা আজ বলি কাল তা সারা দেশ বলবে সে কথায় সত্য কোথায় থাকছে। এইখানে কিছু কিঞ্চিত পরিমাণে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে হেরে রয়েছে দলিত বাঙালির আত্ম-অভিমান। আক্রান্ত হচ্ছে হীনমন্যতার দ্বারা।
রাজনীতি প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সাহিত্য প্রসঙ্গে আসা যাক। এখানে বাংলা সাহিত্য থেকে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কন্নড়, হিন্দি, তামিল, তেলেগু দলিত সাহিত্য অনেক এগিয়ে রয়েছে। বাংলা ভাষায় যে দলিত সাহিত্য বলে কিছু আছে, অন্য প্রদেশতো দূরের কথা বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও সেটা জানত না। বহু সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীর লেখায় রয়ে গেছে তার বহু সাক্ষ্য।
বাংলায় দলিত সাহিত্য আছে এই বক্তব্য প্রমাণ সহ জনৈক মনোরঞ্জন ব্যাপারী ইকনমিক এ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকার মাধ্যমে ভারতবর্ষ শুধু নয় বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। আজ আর কারও ক্ষমতা নেই একে অস্বীকার করে। ঢোক গিলে বলতে হচ্ছে–আছে, ছিল, তবে আমরা জানতাম না।
এটা হল বৃহৎ ব্যাপার। তবে এটা নিয়ে একটা ক্ষুদ্র দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে বাংলা এবং মহারাষ্ট্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে। বাংলার দলিত সমাজ বলছে–মানছি তোমরা দলিত সাহিত্যে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে, কিন্তু আমাদের মনোরঞ্জনের লেখা ইপিড-তে ছাপা হয়েছে। পেরেছো তোমরা এমন মর্যাদাবান কাগজে লেখা ছাপাতে? আমরা পেরেছি।
ওরা জবাব দিয়েছে আছে। আমাদের বামার লেখা তোমাদের চেয়ে আগে ইপিডব্লু ছেপেছিল।
বাংলা জবাব দেয়–বামা ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। সে সামাজিক দিক থেকে দলিত হলেও আর্থিক দিক থেকে কোনো অর্থে দলিত নয়। সর্বার্থে দলিত আমাদের মনোরঞ্জন। কোন ইসকুলে যায়নি, রিকশা চালায়, আর মনোরঞ্জনের লেখা অক্সফোর্ড প্রেসেও ছাপে।
ভারতবর্ষ ঘুরে এই বিতর্ক চলে এসেছে বাংলার দলিত সমাজের বুদ্ধিজীবী মহলে–। এখানে দলিত সমাজের নেতৃত্বে কোন গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের হাতে থাকবে সে নিয়ে নিচু গলায় চলে একটা আন্তর্বিরোধ। চেষ্টা চলে সম্প্রদায়ের সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অন্যে কে কী বলে সে কথা থাক। তবে নমঃশূদ্র সমাজ যে কারণে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে তা হল–অন্যান্য দলিত সমাজের চাইতে তাদের মধ্যে শিক্ষিত-স্বচ্ছল সরকারি চাকুরিজীবীর সংখ্যা অনেক বেশী। তাদের জাতের লোক একদিন নীল বিদ্রোহ করে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ শাসকদের শাসনভিত্তির মূল। হিমালয়ের উচ্চতা কত যে মেপে প্রথম বের করেছিল সে এক নমঃশূদ্র। তাদের রয়েছে হরিচাঁদ গুরুষ্টাদের মতো ধর্মগুরু–সমাজ সংস্কারক। রয়েছে যোগেন মণ্ডলের মতো জননেতা, কুমুদ মল্লিকের মতো ব্যারিস্টার, উপেন বিশ্বাসের মতো সিবিআই অফিসার, অচিন্ত্য বিশ্বাসের মতো অধ্যাপক, অনিল সরকারের মতো কবি, অনিলরঞ্জন বিশ্বাসের মতো মনীষী, গৌতম হালদারের মতো অভিনেতা। মোটকথা সমাজের সবকটি শ্রেষ্ঠ আসনের কোনো না কোনো আসন দখল করে স্বমহিমায় বিরাজমান কোনো না কোনো নমঃশূদ্র। কবি বিনয় মজুমদার, কবিয়াল বিজয় সরকার, বিপ্লবী হেমন্ত ব্যাপারী, ডাক্তার হৃষীকেশ মজুমদার, সুনীল ঠাকুর নমঃশূদ্র সমাজের রত্ন।