পরের দিন দুপুরে কাজের শেষে বাড়ি গেছি, একটা ফোন এল আমার মোবাইলে–ওপারে একটি বিশিষ্ট গলা–আমি কি মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সাথে কথা বলছি? তুমি কি আমাকে চেনো? আমি শৈলেনদা, শৈলেন চৌধুরি। আমি তোমার স্কুলে বসে আছি। তুমি কি একটু আসতে পারবে? একটু কথা বলতাম। আসবে ভাই?
চৌধুরিবাবুকে চিনি। কথা বলিনি কোনোদিন। বলার মতো কোনো ব্যাপার ঘটেনি। উনি প্রতিবন্ধী সংগঠনের মস্ত নেতা। দুধ সাদা গাড়ি চেপে যাওয়া আসা করেন। চোখে দেখেন না তবে বড় চাকরি পেয়েছেন। দুজন লোক ওনার পরিচারক, সদা সঙ্গী, যখন আসেন বড় সাহেবের ঘরে বসে বড় বড় লোকদের সাথে বড় বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। স্কুলের যারা ছোট ছোট লোক ওনার সম্বন্ধে কেউই খুব একটা বড় ধারণা পোষণ করে না। তাই আমি কাছে ঘেঁষিনি, দূরত্ব বজায় রেখেছি। আজ উনি ডাকছেন, দুরত্ব ঘোচাতে চাইছেন, কী যে করি?
বলি–আমার তো এক্ষুনি এক জায়গায় যেতে হবে।
কাতর গলা ওনার–বেশি সময় নেব না। মাত্র পাঁচ মিনিট। একটু দেখা করেই চলে যেও।
অগত্যা যেতে হল। উনি সেই বড় সাহেবের ঘরে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগে বড় সাহেবও ছিলেন। মিটিং শেষ করে তিনি চলে গেছেন। রয়ে গেছেন ইনি, অন্ধ চোখে আমাকে দেখবেন বলে। যারা চক্ষুম্মান পনেরো বছর ধরে দিনে দশবারো ঘণ্টা আমাকে দেখে–তারাই দেখল না, আর উনি তো দৃষ্টিহীন। তবে এখন প্রতিনিধিত্ব করছেন সেই সব ক্ষমতার দম্ভে একদল অন্ধের। যে অন্ধরা অতি কষ্টে দেখে একটা টিউবয়েল, পাম্প করলে জল পড়ে, উচ্চতা আড়াই ফুট। অন্ধত্বের জন্য বুঝতে পারে না এর কতটা প্রোথিত আছে মাটির কত গভীরে, কোন্ নদী, কোন্ সমুদ্র জোগাচ্ছে জলের প্রস্রবন।
বলেন তিনি–শুনলাম তুমি আমাদের স্কুলে রান্না করো লেখো টেখো। আমরা তোমাকে এবার একটা সংবর্ধনা দেব।
বলি–ও সব দিতে হবে না। পারলে একটু কাজের চাপ কমিয়ে দেন, যেন একটু লেখার মতো সময় পাই। সেটা করলেই আমি কৃতার্থ হবো।
বলেন উনি–৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। ওই ব্যাপারটা মিটে যাক তারপর তোমার জন্য কী করা যায় ভেবে দেখব। বড় সাহেবও বলেছেন যাতে তুমি লেখার সময় পাও সেটা উনি দেখবেন।
বলি–আজ থেকে ছয় বছর আগে তারা চ্যানেলের প্রোগ্রাম তারার নজর এর ক্যামেরার সামনে উনি বলেছিলেন আমি যাতে লেখার সময় পাই ব্যবস্থা করে দেবেন। ছয় বছর কেটে গেছে–আজও কিছু করেননি। তখন উনি মন্ত্রী ছিলেন ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারতেন। তখন করেননি, এখন আর কী করে করবেন। তাই ওনার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। যদি সত্যিই কিছু করতে চান, হাতে দশদিন সময় আছে এর মধ্যে কিছু করে দেখান। তা না হলে আমি আপনাদের দেওয়া কোনো সম্মান নেব না।
ওনাকে বড় সাহেব দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আমাকে রাজি করাবার জন্য। বড় সাহেবের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। আমাকে মঞ্চে তুলে পাশে নিয়ে বসবেন। পত্র পত্রিকার সাংবাদিক টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে গলায় দরদ ফুটিয়ে বলবেন–এই ছেলেটা আমার কাছে এল। বলল, আমি লিখি। দেখলাম লেখার হাতটা খুব ভালো। আমিও তো খুব গরিব ঘর থেকে এসেছি, কাজেই এটা আমার কাছে একটা সফট কর্ণার। তাই একে সাহায্য করলাম। বললাম কিছু করতে হবে না, শুধু লিখে যাও। লেখার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেব। যা দরকার চাইবে। আজ ও একটা জায়গায় পৌঁছেছে। সারা দেশে ওর নাম খ্যাতি হয়েছে। এর জন্য আমি আনন্দিত। এই রকম কথাই উনি বলেছিলেন ছয় বছর আগে, টিভি ক্যামেরার সামনে। আবার এখন বলবেন। মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল, তাই আবার মনে করিয়ে দেবেন যে উনি এক রাস্তার মানুষকে তুলে নিয়ে লেখক বানিয়ে দিয়েছেন।
আমার কথায় শৈলেনবাবু মনে বড় কষ্ট পেলেন। চলে গেলেন তিনি সেই কষ্ট নিয়ে। আগেকার দিন হলে এইসব লোকের মনে কষ্ট দিতে আমি কেন, আচ্ছা আচ্ছা লোক সাহস পেত না। এখন আমি মরিয়া। কী করতে পারে ওঁরা? যেভাবে মুড়ির টিন ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মুড়ি ঢোকায় সেইভাবে কোথায় কোন ফাঁক ফোকর আছে গুঁজে দিয়েছে একটা বাড়তি কাজ। আর কাজের চাপ বাড়িয়ে দেবার সুযোগ নেই। পারবে শুধু কোন্ ছুতো বানিয়ে আমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে। সে তো আমি এমনিতেই আর করতে পারবো না। নিজে থেকেই ছেড়ে পালাতে হবে। সেই যে পিন্টু সেন মেরেছিল, তখন বয়স কম ছিল, মালুম পাইনি, এখন যত বয়স বাড়ছে দুটো হাঁটুতে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। জখম পায়ের উপর আর আট দশ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সেই যখন চলে যেতেই হবে বাবুদের তুষ্ট করে কী হবে!
এ্যাপোলো ক্লিনিকের ডাক্তার প্রসেনজিৎ বড়াল আমার হাঁটু পরীক্ষা করে ওষুধ দিয়েছেন ইনজেকশন দিয়েছেন আর দিয়েছেন বিধান–২০ মিনিটের বেশি একটানা দাঁড়ানো বা হাঁটা চলবে না, সাইকেল চালাবেন না। নিয়ম না মানলে যত ওষুধ ইনজেকশান নিন, হাঁটুর ব্যথা সারবে না।
তাই সারছে না। সাইকেল না চালিয়ে না হেঁটে বাড়ি থেকে চারবার–তিন/চারে–বারো মাইল পথ পার হয়ে কর্মস্থলে আসা যাওয়া করব কি ভাবে? অন্য কোনো বাহন যে ওই পথে চলে না। আর দাঁড়িয়ে না থাকলে রান্না করব কি করে? যে কড়াইয়ে একবারে কুড়ি কিলো চাল ফোটে তরকারি রান্না হয়, বসে বসে তাতে রান্না করা অসম্ভব। এর উপর ওই সব ভারি গামলা সেও বহন করে রান্নার জায়গা থেকে খাবার জায়গায় নিয়ে যাবার ব্যাপার আছে। পরিবেশন, সেও বসে বসে করা যাবে না। সবটা মিলিয়ে আট দশ ঘণ্টা দুটো পায়ের উপর না দাঁড়িয়ে থেকে রেহাই নেই।