উচ্চবর্ণ সব লোকই যে এমন হিংস্র ক্রুর তা নয়। যেমন সব বিষ নয় প্রাণঘাতী, সব বিষ্ঠা নয় সমান দুর্গন্ধ। গরুর বিষ্ঠায় তো উঠোন নিকানো হয়। যে ব্যক্তি নিজেকে মানুষ হিসাবে প্রতিপন্ন করার চাইতে গর্ব যে কহে হাম হিন্দু হ্যায় মুসলমান হ্যায় কী উচ্চবর্ণ হ্যায় বলে হুঙ্কার ছাড়ে সে সমাজের পক্ষে বিষ বা বিষ্ঠার চেয়ে উচ্চ কিছু নয়। কিছু কিছু উচ্চবর্ণ নিজেদের উচ্চে রেখে মাঝে মাঝে বাণী দেন বর্ণ ব্যবস্থাটা খুবই খারাপ, তবে আমি ওর দ্বারা আচ্ছন্ন নই। পৈতেটা গলায় রাখি, না হলে মা মনে কষ্ট পাবে। পদবিটা বর্জন করতে পারি না কারণ আমি ওটাকে জাত পরিচয় উপনাম মনে করি না। সবার সাথে মিশি সবার হাতে খাই।
এই অপেক্ষাকৃত নরম মনের লোকেরা নিজেরাও জানেন না যে তার কোন কাজ কোন কথা নিম্নবর্ণের পক্ষে অসহ্য অপমানজনক।
জাতপাত অস্বীকারের প্রশ্নে সব চেয়ে এগিয়ে আছে বামপন্থীরা। আমিও এক সময় বামপন্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছি। আজও তাই আছি। তবে বঙ্গে যে বামপন্থার চেহারা চরিত্র দেখেছি এবং দেখছি, এই যদি বামপন্থা হয় আমি ভাই চরম প্রতিক্রিয়াশীল হতে রাজি আছি। এই বামপন্থা নিপাত যাক।
***
১৫. বিশ্বমঞ্চে মনোরঞ্জন
২০১১ সোমবার ১৯ নভেম্বর এই সময় পত্রিকার পাঁচের পাতায় প্রকাশিত হয় কৌশিক সরকারের প্রতিবেদন কলমে জীবনের জলছবি এঁকে ‘বিশ্বমঞ্চে মনোরঞ্জন’, বুধবার সন্ধ্যায় আমাকে ডাকলেন বড় সাহেব। ওনার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায় ঋজু বসুর প্রতিবেদন মহীরুহ নয়, লড়াকু বটের চারাই তার প্রেরণা প্রকাশিত হবার পরে। সে প্রায় ছয় বছর আগে। তারপর এক দীর্ঘ নীরবতা। দেখেছেন আমাকে অনেকবার। কথা বলেননি–। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমিও-কী বলব আর না বলব ভেবে চুপ করে থেকেছি। আজ এত বছর বাদে ডেকে পাঠানোতে একটু অবাক হই।
আজকাল উনি প্রায় দিনই মুক বধির বিদ্যালয়ে আসেন। যখন মন্ত্রী ছিলেন সময় পেতেন না। এখন মন্ত্রিত্ব নেই। সময় কাটে না। এখানে এসে কিছুক্ষণ হাঁটেন কিছুক্ষণ বসেন কোনো কোনদিন তাসও খেলেন। এইভাবে পার করেন দুঃসহ সময়। আর কাল গোনেন সুসময়ের। আহা কত সুখের ছিল তিনটি দশক। চারদিক থেকে ঘিরে থাকত চাটুকার জনগণ। কৃপাভিক্ষু প্রমোটার ঠিকেদার, স্তাবক আমলা অফিসার। সে সবদিন আর নেই। বড় একা হয়ে গেছেন, ফাঁকা হয়ে গেছেন।
ডাক পেয়ে ওনার নিজস্বকক্ষে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি মৃদু হাসলেন আমাকে দেখে বুক শিরশির করে উঠল আমার। এই হাসি তত সাধারণ হাসি নয়, এতে রাজনীতি আছে কূটনীতি আছে। এই হাসি আমার অচেনা নয়।
বলেন তিনি–তোর কথা পেপারে পড়ছি।
এ আর নতুন কথা কী! লক্ষ লোকে পড়েছে। উনি তো ___ বৰ্তমানও না পড়ে পার পায়নি। এই সংবাদ শুনে আমি অতটা আশ্চর্য হই না। হই তার পরের বাক্যে। “আমরা এবার তোকে একটা সম্মান জানাবো।”
সেই বহু বছর আগে একবার ঠিক যেভাবে দুম করে আগুপিছু না ভেবে বলে বসেছিলাম তার মুখের সামনে নিজের বিরুদ্ধে বক্তব্য, আজও তাই হয়ে গেল। সামলাতে পারলাম না নিজেকে। বুকের ভিতর থেকে উঠে এল বিয়ারের বোতলের মতো ছিপি খোলা উগ্র উম্মা–“আপনাদের সম্মান চাই না।”
উনি কী চমকে উঠলেন এই অবমানিত ‘না’ এর বিদ্যুৎ ঝটকায়, চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল তার। উনি সম্মান দেবেন, তার জন্য যার ধন্য হয়ে পায়ে লুটিয়ে পড়ার কথা সেই তৃণদপি তুচ্ছ জেহাদ ঘোষণা করছে! নেবনা। খুব সংযত শব্দে সীমিত বাক্যে ছোট্ট একটা মানবিক বোমা ছুঁড়ে দিই আমি যদি পারেন যে অপমান অত্যাচারের আগুনে নিত্য দহন হচ্ছি সেটা একটু সহনশীলতার মধ্যে নামিয়ে আনুন আর কাজের চাপটা একটু কমিয়ে দিন। উত্তরে উনি কী বলবেন শোনার জন্য অপেক্ষা করি না। কথাটা শেষ করে দোর ঠেলে বাইরে বের হয়ে আসি। বুকটা বড় হালকা লাগে আমার, বড় নির্ভার গ্রহণে যে আনন্দ আছে সেটা জানতাম, বর্জনে যে এত আনন্দ সেটা এই প্রথম জানলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন, এই কিছুদিন আগে গাদা গাদা বুদ্ধিজীবী বর্জন করেছেন গাদা গাদা পদক পদ পুরস্কার সম্মাননা। কী সেই আনন্দ আমি আজ বুঝতে পারলাম। এখন নিজেকে মনে হল আলেকজান্ডারের মতো সম্রাট। যিনি পরাজিত পুরুকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তার রাজ্য–অনেক আছে আমার, যা, তোরটা আর নেব না।
আগে আমি যাকে বড় সাহেবের ডানহাত বলে উল্লেখ করেছি সেই হাত এসে আমার সামনে দাঁড়াল–কাজটা ঠিক করলেন না।
কোন্ কাজটা?
বড় সাহেবের মুখের উপর না বলা। উনি এতে অপমানিত হয়েছেন।
উনি তাই বললেন?
বলে কখনও। মুখ দেখে বোঝেননি?
পনেরো বছর দুবেলা চিতার সামনে বসে থাকি, বোঝার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছে আমার।
বুঝলাম ডান হাতও অপমান বোধ করছে, মনে কষ্ট পাচ্ছে। রাত তখন সাড়ে আটটা। বাচ্চাদের খেতে দিতে হবে। আমার কোনো সহকারি নেই। যে একজন ছিল সে তিন চার মাস অসুস্থ। আসছে না আর। শুনলাম নাকি কুষ্ঠ হয়েছে। এই রোগে সবেতন ছুটির নিয়ম আছে। এখন আমি একেবারে একা আমাকে খেতে দিতে হবে প্রায় দেড়শো খাদককে। যদি খাদ্য না পায়, যদি কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি হয়–সবাই মিলে আমাকে খাবে। এই দুঃসময়ে লোকের মান অপমান নিয়ে ভেবে মরার সময় কোথায়!