বার বার মৃত্যুকে একেবারে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি এই কারণে আমার উপলব্ধিতে, জীবন বড় সুন্দর। জীবনের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। সেই সুন্দর জীবনের তপস্যা হোক, মৃত্যুর উপাসনা বন্ধ হোক। জীবন যেন কোন কারণে কারও হাতে নিহত না হয়। পুলিশের রাইফেল থেকে ছুটে যাওয়া বুলেট যেন বিদ্ধ না করে কোন আদিবাসির বুক, জঙ্গল থেকে ছুঁড়ে দেওয়া কোন গুলি যেন না বেঁধে পেটের দায়ে চাকরি করতে আসা সৈনিকের মাথায়।
আসল শত্রু থেকে গেল নাগালের বাইরে আর নিজেরা নিজেদের মারছে দুই দরিদ্র, এই মরণ খেলা বন্ধ হোক। এই মৃত্যুর মিছিল আর চাই না। চাই না।
এই যে সেদিন মরতে মরতে বেঁচে এসেছি, এই জীবন কাহিনি লিখে ফেলার এটাও একটা বড় কারণ। দশবার ফিরেছি–যার কয়েকটা এতে লিখেছি, কয়েকটা কোনদিন লিখব। অবশ্যই যদি বেঁচে থাকি। এখন সর্বদাই ভয়–এতবার ফিরেছি, যদি আর ফিরতে না পারি? আর যদি সম্ভব না হয় তার করাল থাবা থেকে পিছলে যাওয়া।
মরতে আমার ভয় নেই। জন্ম যখন হয়েছে মৃত্যু তো আসবেই। তা না হলে বৃত্ত তো সম্পূর্ণ হবে না। আমার ভয়, আমি মারা গেলে সেই মৃত্যুর সাথে লুপ্ত হয়ে যাবে আমার বিড়ম্বিত জীবন কাহিনি। কেউ কী জানবে কী বীভৎস এক ভয়াল সময়ের গর্ভে কী নিদারুণ যন্ত্রণাবিদ্ধ বুকে বেঁচে ছিলাম এতগুলো বছর?
শিকার কাহিনীর মত উত্তেজক, গোয়েন্দা কাহিনীর মতো রোমাঞ্চকর, ভ্রমণ কাহিনীর মতো বৈচিত্রময় আবার আকাল কাহিনীর মতো হাহাকার মাখা এই যে জীবন, সব যে ছাই হয়ে যাবে আমার মরদেহের সাথে। তলিয়ে যাব বিস্মৃতির অতল তলে। তাই লিখে রেখে গেলাম।
আজ থেকে বহুবছর পরে কোন এক লাইব্রেরির ধুলোমাখা তাক থেকে নামিয়ে বিবর্ণ মলিন এই কাহিনি পড়ে অবাক বিস্ময়ে হয়তো ভাববে কেউ, এমন একজন মানুষ ছিল। সত্যিই কী ছিল। পৃথিবীতে এমনভাবে কেউ কী বাঁচে, পারে বেঁচে থাকতে! আর এই জিজ্ঞাসার মধ্যে আমি তখনও বেঁচে থাকব। সার্থক হবে সেদিন জিজীবিষার সাধনা।
এক এক সময় আমি নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করি, এত ঘটনা-দুর্ঘটনার সমাহার একটা জীবনে, সে কি অকারণ? এর কি কোন মূল্য নেই?
আজ মনে হচ্ছে জীবন আমাকে যে পথের যাত্রী করেছিল, বারবার আমাকে যে ঘাত-প্রতিঘাত বিভিন্ন বিচিত্র অভিজ্ঞতার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা যেন এই জীবন কাহিনীটা লেখার উপাদান সংগ্রহের জন্যই। আর কিছু নয়, মাত্র একখানা আত্মজীবনী।
যেন এই কাজটি সুসম্পন্ন করার জন্যই মৃত্যুর অধিপতি ক্ষমা ঘেন্না করে বাঁচতে দিয়েছে আমাকে এত দীর্ঘ সময়। কাজটি সম্পূর্ণ হবার পরই বোটা থেকে খসে যাব পাকা ফলটির মতো। বিশ্রাম পাবো এক প্রচণ্ড প্রব্রজ্যা থেকে।
পরিশেষে আর একটি কথা, সমাজে লেখক হিসাবে আমার অবস্থিতি কোথায় আমার তা জানা নেই। তবে এই ৩৫/৩৬ বছরে আমার যেটুকু অর্জন, আজ রাখতে পারছি, সে আমার একক। অর্জন নয়। বহু মানুষ বহুভাবে আমাকে সাহায্য করেছে এখানে পৌঁছাতে। তাদের সংখ্যাও এত যে গুণে শেষ করা যাবে না।
ব্যক্তি মানুষের কোন প্রয়াস কখনওই একক প্রচেষ্টায় সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না। যদি না সময় সমাজ মানুষের সহযোগিতা থাকে। আমার ক্ষেত্রে এই কথাটা বড় বেশি রকম সত্যি। বহু মানুষ যেমন জানেন, আমাকে কী সহযোগিতা দিয়েছেন, বহু মানুষ তা জানতেও পারেননি। আমি উপকৃত, সবার দ্বারা। সেই যে পাথর খণ্ড তার কী ক্ষমতা ছিল ভাস্কর্য হবার। সে তো খোদাই শিল্পীর ছেনি হাতুড়ির আঘাতের ফলাফল।
আমি কৃতজ্ঞ সেই পিঠে টুকরো হওয়া পাঁচনবারি খানার কাছে যে আমাকে গরু খেদাবার মতো খেদিয়ে দিয়েছে ভবিষ্যতের যাত্রা পথে। কৃতজ্ঞ সেই লাইট পোষ্টটার প্রতিও, যাতে চোরের মতো বাধা হয়েছিল আমাকে, বুঝতে সাহায্য করেছিল দারিদ্র কী ভীষণ অপরাধ। কৃতজ্ঞতা জানাই সেই জাল ঢাকা কালো গাড়িখানাকে যে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়–জেলখানায়। আর আমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ সেই রিক্সাটার প্রতি–একদিন যার চাকা গড়িয়েছিল আমার ভাগ্যচক্র হয়ে।
০১. এই যে আমি
এই যে আমি। আমি জানি যে আমি আপনার একেবারে অপরিচিত নই। কত শতবার কতভাবে দেখেছেন আমাকে! তবু যদি বলেন যে চিনতে পারছেন না, আমি যদি একটু বিশদ ভাবে বুঝিয়ে বলি, তখন আর তা মনে হবে না। সব অপরিচয়ের অন্ধকার সরে গেলে আপনার মনে হবে, হ্যাঁ একে চিনি, আমি দেখেছি এই মানুষটাকে।
মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল। তাই পুরনো কথা মনে করার জন্য স্মৃতির উপর চাপ দেবার কথা বলছি না! এখনই আপনি জানালা দিয়ে সামনের সবুজ মাঠটার দিকে একবার তাকান। দেখতে পাবেন ছাগল গরুর পিছনে পাঁচনবারি হাতে ছুটে চলা আদুল গায়ে এক রাখাল বালককে। বহু বছর ধরে দেখেছেন ছেলেটাকে। মুখটা তাই আপনার চেনা চেনা। ও-ই আমি। ও-ই হচ্ছে আমার বাল্যবেলা।
এবার একটু বের হয়ে আসুন বাড়ির বাইরে। আপনার গলিটা শেষ হয়ে যেখানে এসে বড় রাস্তায় মিশেছে, একবার তাকান মোড়ের চা দোকানটার দিকে। রুক্ষচুল, গায়ে দুর্গন্ধ যুক্ত ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জি, হাতে পায়ে দগদগে হাজা, কিছুক্ষণ আগে মালিকের হাতে মার খেয়ে কেঁদে কেঁদে গেলাস ধোয়া ওই যে ছেলেটা–এই হচ্ছে আমার কিশোর কাল।