এখন আমার দিকে একটা সুতীব্র প্রশ্নের বর্শামুখ ধেয়ে আসতে পারে, যদি সব কথা ইতিপূর্বে বহুবার বহুভাবে বলা হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আবার আর একটা আত্মজীবনী লেখার আবশ্যকতা কোথায়। নতুনত্ব কি আছে এতে!
সোনাতে যেমন খাদ না মেশালে গহনা হবে না। তেমনই গল্প উপন্যাসকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে হলে কিছু রূপক কিছু অলঙ্কার কিছু উপমা উদাহরণের সাহায্য নিতে হয় তার অবয়ব এবং অঙ্গসজ্জার জন্য। স্থান কাল পাত্র বদলে দিতে হয়। করতে হয় অনেক কারিকুরি। এই সব কৃত-কৌশলে নির্মিত প্রতিমাতে শিল্পীর শিল্প নৈপুণ্য প্রধান হয়ে ওঠে। আর সেই শিল্পকলার করে ঢাকা পড়ে যায় আসল উপাদান–সেই খড়-মাটি-কাঠ অথবা “সত্য”। যে সত্যকে জানাবার অবদমিত আকাঙ্খতেই সে একদা হাতে কলম তুলে নিয়েছিল।
আমার জীবনের তিনটি ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে একদা–”শমন সকাশে তিনদিন” নামে একটা বড় লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। বহু পাঠক সেটা গোয়েন্দা গল্প পাঠের আনন্দে পড়েছে। লেখকের লেখার মুন্সিয়ানার প্রশংসাও করেছে। কিন্তু কেউ মানতে পারেনি সত্য বলে। কারণ সেটা যে গল্প। আর যাইহোক গল্প কখনও সত্যি হয় না।
সেই সত্যকেরূঢ় রুক্ষ নির্মম বীভৎস বাস্তবতাকে, মেদ বর্জিত অলঙ্কারবিহীন অমল অবয়বে উপস্থাপনের তাগিদে, সময় সমাজ মানুষের দরবারে ন্যায় বিচারার্থে নিজেকে প্রস্তুত করার নিমিত্তে, এই আত্মজৈবনিক আলেখ্যের অবতারণা।
পাঠক বিশ্বাস রাখতে পারেন, বর্ণনার কোন স্তরে বিন্দুমাত্র সত্য থেকে বিচ্যুত হইনি বা বিকৃত করিনি। যেটুকু পারিনি সে আমার অপারগতা। তবে যেটুকু বলেছি–নিজে যা বিশ্বাস করি সেটাই উচ্চারণ করেছি উচ্চনাদে। ঋজু অকপটতায়।
আমার এই লেখায় কোথাও কোথাও আমাকে মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে মনে হওয়া অসম্ভব নয়। ঘটনাচক্রে আমি এক সময় নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। দেশের শোষিত বঞ্চিত মানুষদের প্রতি তাদের যে দরদ ভালোবাসা সে জন্য কঠোর কৃচ্ছসাধন, আত্মবলিদান–এ আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এমন নিঃস্বার্থ দেশ সেবকদের প্রতি যদি সহমর্মিতা না দেখাই নিজের কাছেই আমি অপরাধী হয়ে যাব। ছোট হয়ে যাব।
আমার নেতা শহিদ শঙ্কর গুহ নিয়োগী বলেছিলেন, আমি নকশালদের প্রতিটা কথা প্রত্যেকটা কাজের সমর্থন করি। শুধু সমর্থন করি না কাঁধের ওই বন্দুকটা। আমি যখন শঙ্কর গুহ নিয়োগীর লোক, তাই তার কথার প্রতিধ্বনি করে বলব–আমি নকশালদের শুধু অন্ধ সমর্থকই নই, বন্ধু সাথী সহযোদ্ধা-কমরেড। কেবল মাত্র সমর্থন করি না ওই বন্দুকটাকে।
আমার যেটুকু যা পড়াশোনা, আন্দোলনে অংশ নিয়ে মানুষকে দেখে বেড়াবার অভিজ্ঞতা তারই নিরিখে বলতে পারি, এ দেশের মানুষের প্রতি যতই শোষণ-বঞ্চনা-দমন পীড়ন হয়ে থাকুক, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শোষণ ব্যবস্থাকে উৎখাত করা তথা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল–এর জন্য এখনও মানসিক দিক থেকে মানুষ সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়। সেই রাজনৈতিক চেতনা তাদের মধ্যে বিকশিত হয়নি। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জঙ্গল পাহাড় কিছু দুর্গম এলাকায় সামান্য কিছু আধিপত্য কায়েম করা গেলেও তা দিয়ে বৃহত্তর মানব সমাজের কোন মঙ্গল সাধিত হবার নয়। সেই সুবৃহৎ সংগ্রাম সঞ্চালন এবং বিজয় অর্জনের উদ্দেশ্য, সফল করার লক্ষ্যে মানুষকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও সুসংগঠিত করবার জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্রম দরকার। যার সূচনা করেছেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী।
নকশাল-তথা মাওবাদীরা য়ে ধরনের ব্যক্তি হত্যার ক্রিয়া কলাপ চালিয়ে ছিল সুস্থ-সাধারণ মানুষ তার সমর্থন করতে পারে না। এতে দেশ দরদী মহান বিপ্লবী নয়, তাদের যে প্রতিকৃতি জনমানসে নির্মিত হয়েছিল তা ভয়াল বীভৎস এক ক্রুর হত্যাকারীর। যাতে প্রকারান্তরে তাদেরই ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্র তার সশস্ত্র বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে বর্বর দমন পীড়ন চালাবার একটা অজুহাত পেয়ে গিয়েছিল। যা তারা চায়। আর সেই গুলির আওয়াজ রক্তস্রোতের নিচে চাপা পড়ে গেছে বুভুক্ষার কান্না। মানুষের মৌলিক দাবি, মানবিক অধিকার ন্যায় অন্যায়ের বিভেদ রেখা।
এ কথা মনে রাখা দরকার যদি সেদিন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গাড়ির পিছনে ওই পটকাটা ফাটানোনা হতো, এত সহজে কেন্দ্রীয় বাহিনী জঙ্গল মহলে অনুপ্রবেশের অজুহাত পেত না। আর আজ মারা পড়ত না কিষেণজীর মতো বড় মাপের নেতা। যে বিরাট ক্ষতি তাদের স্বীকার করতে হল সেই তুলনায় প্রাপ্তি কতটুকু!
গত ১৪.৪.২০১০ তারিখে যুগ পরিবর্তন পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলাম “আমি মৃত্যুর বিরুদ্ধে। আমার আন্তরিক কামনা সমস্ত রকম মৃত্যুকে পরাজিত করে জয়ী হোক জীবন। জয়ী হোক মানুষ এবং শুভশক্তি। আমি বিশ্বাস করি এদেশের সমস্ত শ্রমিক কৃষককবি শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সবাই চান হিংসাদীর্ণ দেশে শান্তি আসুক। এত রক্তপাত এত জীবনহানি বন্ধ হোক।”
আমি আমার বিশ্বাসে অটল। আমি আজও মৃত্যুর বিরুদ্ধে, জীবনের পক্ষে। এই কাহিনি যারা পড়বেন জানতে পারবেন-জীবন আমাকে বার বার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মৃত্যুর মুখোমুখি। এই তো সেদিন ২০১১ সালে যেদিন পশ্চিমবঙ্গে বর্ষার প্রথম বৃষ্টি নামল সেদিন ভীষণভাবে পুড়ে গিয়েছিলাম। নয়-দশদিন এক বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি থেকে ব্যায়বহুল চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক বারের মতো আরও একবার প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছি।