আমরা তো প্রায় ছয়বছর, কারও কারও আরও বেশি। এতদীর্ঘ সময়কাল ধরে এক নারকীয় অবস্থার মধ্যে ক্যাম্পে ফেলে রাখা হয়েছিল হাজার হাজার মানুষকে। কে জানে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের হয়ত আশা ছিল, এত কষ্ট সহ্য না করতে পেরে এরা যে যেখানে পারে চলে যাবে। যখন কেউ ক্যাম্প ছেড়ে নড়ল না তখন তাদের উচ্চবর্ণ উচ্চমস্তিষ্ক থেকে বের হল এক পরিকল্পনা–যেমন মানুষ তাদের পাঠান হবে তেমনই এক উপযুক্ত স্থানে, আর সেটা আন্দামান। ইংরেজ শাসনকালে সাজা দিয়ে যেখানে খুনি ডাকাতদের পাঠান হতো। এগুলোকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়া যাক। এরপর মরুক বাঁচুক যা পারে হোক।
বাঙালী মননে চিন্তনে তখনও আন্দামানদ্বীপ কোন মনুষ্য বসবাসের উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত হয়নি। তাদের ধারণায়, ওটা কঠোর শাস্তিদানের স্থান। যেখানে সব মারাত্মক ধরনের অপরাধীদের মরবার জন্যই প্রেরণ করা হয়। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির বলতে গেলে পায়ের নিচে শক্ত মাটি ছিল না। গোটা কয়েক নেতা সর্বস্ব এই দল থেকে সাধারণ মানুষ ছিল শত মাইল দুরে। গুটি কয়েক বিদ্বান নেতা এর তত্ত্ব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা, পত্র পত্রিকায় নিবন্ধ লেখা এই নিয়ে মগ্ন ছিলেন। এবার ঘোলাজলে মাছ ধরার একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলেন। যে সুযোগের তারা প্রতীক্ষায় ছিলেন। আঁপিয়ে পড়ল তাই নিজেদের উচ্চাশা পূরণের নিমিত্তে রিফিউজিদের মাঝে, পার্টি গড়ার কাজে। নানা রকম কথা বলে বাড়িয়ে দিল তাদের ভয়ভীতি আর জাগিয়ে তুলল আশা।–”আমরা তোমাদের পাশে আছি। কেউ যেওনা আন্দামান। আমরা আন্দোলন করে তোমাদের এই বাংলাতেই পুনর্বাসন দেওয়াব।” এর ফলে রিফিউজিরা আর আন্দামান যেতে রাজি হল না। বন্ধ হয়ে গেল কেন্দ্রীয় সরকারের সেই পুনর্বাসন প্রকল্প।
আজ এত বছর পরে মনে হয় সেদিন রিফিউজিদের জন্য সরকার পক্ষ যা করতে চেয়েছিল, আর কমিউনিস্ট পার্টি যা করেছিল, দুই তরফের কোথাও কোন দয়া দরদ আন্তরিকতার লেশমাত্র ছিল না। ছিল দুরভিসন্ধি, কাপট্য, বেড়ালব্রত, উদ্দেশ্য পূরণের নকড়াছকড়া। তবে সেদিন যদি রিফিউজিরা কমিউনিস্টদের প্ররোচনার ফাঁদে পা না দিয়ে আন্দামান চলে যেত, সেটা অন্ততঃ মন্দের ভাল হোত। এখন যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, যারা সেদিন মনভোলানো কথায় না ভুলে চলে গিয়েছিল তারা ভাল আছে, সুখে আছে। অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গের রিফিউজিদের চেয়ে শতেকগুণে ভাল।
এসব যখন ঘটে, আমার বাবা তখনও এদেশে আসেননি। আমরা শিরোমণিপুরে আসবার পূর্বেই সম্ভবতঃ আন্দামান পর্ব চুকেবুকে গিয়েছিল। কারণ এই বিষয় নিয়ে তখন সরকার বা কমিউনিস্ট বা রিফিউজি কোন তরফে কোন হেলদোল কোন আলোচনা তাপ উত্তাপ কিছুই ছিলনা। তখনকার রিফিউজি ক্যাম্পগুলো ছিল একটা বদ্ধ জলাশয়ের মতো নিথর নিশ্চুপ নির্জীব। মানুষগুলোর চোখের মণিতে কোন আলো আশা ঔজ্জ্বল্য ছিল না। মুখে ছিল না গল্প গান হাসি কথা। সব যেন তখন হতাশায় দড়িবাধা জাবরকাটা গরুর মত ধুঁকছে। কীযে হবে আর না হবে সেই ভয় ভাবনায় অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে শুধু দিন গুনছে।
এইভাবে আরও বেশ কয়েকটা অলসমন্থর বছর পার হবার পর সরকারি কর্তা নেতা মন্ত্রীদের মগজে এল দ্বিতীয় পরিকল্পনা। যার নাম দণ্ডকারণ্য পুনর্বাসন পরিকল্পনা। দণ্ডকারণ্য অথরিটি স্থাপিত হয় ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ সালে। এখন যার নাম ছত্তিশগড়, এর সাতটি জেলার মধ্যে সবচেয়ে অনুন্নত জেলা বস্তর। ঠিক অনুরূপ উড়িষ্যার সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অনুন্নত জেলা মালকানগিরি। এই দুই প্রদেশের দুই জেলার অনুন্নত দুর্গম অস্বাস্থ্যকর বন্ধ্যাভূমির কিছু বনাঞ্চল নিয়ে গঠন করা হয়েছে দণ্ডকারণ্য অঞ্চল। এখানেই “পুনর্বাসন” দেওয়া হবে এই সব রিফিউজিদের।
এ এমন এক অঞ্চল যেখানে কোন সভ্য জগতের মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে কিনা তা বোঝা যায় না। এখানে বসবাস করে একদল আদিম জনগোষ্ঠীর প্রায় বিবস্ত্র মানুষ। যাদের ভাষা সংস্কৃতি ধর্মাচারণ খাদ্যদ্রব্য সবকিছুর সাথে বঙ্গজীবনের তিল পরিমাণ মিল খুঁজে বের করা মুশকিলই নয়, অসম্ভব কঠিন। এই বনরাজ্যে আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি, জ্ঞান বিজ্ঞানের অতি সামান্য বিকিরণও অনুপ্রবেশ করার পথ পায়নি। সভ্যতা এখানে যেন সদ্য অন্ধকার গুহা ছেড়ে বাইরে এসেছে। প্রস্তর যুগ শেষ হয়ে মানব সমাজ এইমাত্র প্রবেশ করেছে লৌহ যুগে।
এখানকার মাটিতে মুরোম কাঁকর পাথরের মাত্রা খুব বেশি। এই মাটিতে হাল চলে না, কোদাল বসে না তাই ফসল ফলে না। আদিবাসীরা চাষবাস বিশেষ একটা করে না। চাষ করতে জানেও না। বনে যে সব ফলমূল পশুপাখি সাপ ব্যাঙ ইঁদুর বাদর যা পায় ধরে মেরে খেয়ে বেঁচে থাকে। যারা বেঁচে থাকে তার মধ্যে একটা ভাগ নানাবিধ রোগে, জন্তু জানোয়ারের আক্রমণে মরে যায়। এই সব কারণে বিশাল এই অঞ্চলে তুলনামূলক ভাবে জনসংখ্যার পরিমাণ খুবই কম।
এখানে রিফিউজিদের নিয়ে গিয়ে ফেলে দিতে পারলে একঢিলে দুটো পাখি মারা যায়। একটা–রিফিউজিদের পুনর্বাসনের বিচ্ছিরি ঝামেলাটার সহজ সমাধান, আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, এই যে বিশাল বনাঞ্চল যেখানে রয়েছে শাল সেগুন বীজা মহুয়া করর্যা গাছ আর বাঁশের অপার সম্ভার। রয়েছে কেন্দুপাতার অফুরন্ত উৎপাদন। বাঁশে যেমন কাগজ __ মহুয়ার ফুলে মদ, ফলে তেল। শাল সেগুন বীজা গাছে দামি আসবাব।