এরপর সেই শুভদিনে, সকালে আমাকে চান করিয়ে, কানের পাশ থেকে গড়িয়ে আসার মত মাথায় চপচপে সরষের তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে, নববস্ত্র পরিয়ে, এক বগলে বামুনে পৈতার মত দড়িবাধা একগোছা তালপাতা অন্য বগলে এক বোতল ভুষিকালি, পকেটে কঞ্চির কলম, তালপাতা পোছবার জন্য জল ন্যাকড়া, বসবার জন্য ছেঁড়া চট, দুপুরে যখন খিদে লাগবে, অর্থাৎ টিফিন টাইমে খাবার জন্য খুদের নাড়ু। এসব দিয়ে আমার হাত ধরে বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন স্কুলে। স্কুলটি আমাদের তাবু থেকে অতি সামান্যইঁদুরে। স্কুলে ঘন্টা বাজালে আমাদের তাবু থেকে শোনা যায়। বাবা চেয়েছিলেন আমার চোখে আলো জ্বালবেন, স্কুলের সামনে পৌঁছে তার সে আশার আলো দপ করে নিভে গেল। কারণ, স্কুল আর খুলবে না। আজ থেকে সব পড়াশোনা বন্ধ।
এরপর বেলা যত বাড়তে থাকল একটার পর একটা দুঃসংবাদ পাওয়া যেতে লাগল। জানা গেল রিফিউজিরা এতদিন ধরে ডোল বাবদ যে সব চালডাল অর্থ সাহায্য পেত সে আর পাওয়া যাবে না। যার যার দায়িত্ব এখন তার তার। আজ থেকে সরকার রিফিউজিদের আর কোন দায় দায়িত্ব নেবেনা। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া, আর্থিক দিক থেকে দুর্বল একটা সরকারের পক্ষে এভাবে দিনের পর দিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ান আর সম্ভবপর হবে না। এতে দেশের যে রকম, প্রকারান্তরে সেই মানুষটির নিজেরও বিরাট ক্ষতি। সে বসে বসে খেতে পেয়ে অলস কর্মভীরু হয়ে যাচ্ছে। এটা কাম্য নয়।
একথা এই সরকার ছাড়া কারও পক্ষে অস্বীকার করবার উপায় নেই যে নমঃ পোঁদ জেলে মালো এই সব লোক কঠোর পরিশ্রমী। এরা কেউই শখ করে ক্যাম্পে বসে খাবার জন্য দেশত্যাগ করে আসেনি। এসেছে প্রাণের দায়ে মান সম্মানের ভয়ে। এদের এসব ভয় না থাকলে কোনদিন দেশ ছেড়ে আসত না। যে মানুষ দেশভাগ জনিত কারণে বাঁধভাঙা বন্যার জলের মত, একান্ত বাধ্য হয়ে আছড়ে পড়েছিল এপার বাংলায়, এই সব ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে ছিল স্পষ্টতঃ দুটো ভাগ। একভাগ সচ্ছল শিক্ষিত উচ্চবর্ণ–এক কথায় যাদের বলা হয় ভদ্রলোক। আর একদল হল নিঃস্ব নিরক্ষর নির্ধন, নিম্নবর্ণ।যারা তথাকথিত ভদ্র লোকদের কাছে ছোটজাত ছোটলোক। যারা ভদ্রলোক তারা তাদের চিরকালের বর্ণবিদ্বেষ প্রসূত মানসিকতার কারণে নমঃ পোঁদ জেলে কামার কুমোর জোলা হাড়ি মুচি মানুষদের সাথে সহাবস্থানে রাজি ছিল না। তাই তারা কেউ খাতায় নাম লিখিয়ে ডোল নির্ভর ক্যাম্প বাসিন্দা হতে চায়নি। এরা সরকারের স্বজাতের নেতামন্ত্রীদের সমর্থন সহযোগিতায় কলকাতা ও তৎসংলগ্ন নানা অঞ্চলে একের পর এক প্রায় দেড়শত জবরদখল কলোনী গড়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। কিছু লেখাপড়া জানা থাকার কারণে কিছু রাজনৈতিক যোগাযোগের ফলে, কিছু জাতিগত ধূর্ততা শঠতার কৌশলে চাকরি ব্যবসা বা অন্য কোন উপায়ে রুজিরোজগার ধনাগমের সুব্যবস্থা করে নিতে বিশেষ কোন অসুবিধার সামনে পড়েনি। এরা সুখেই ছিল এবং সত্য এটাই যে অনেকে এত সুখ পূর্ববাংলায়ও ভোগ করতে পারেনি।
এর বাইরে যে লক্ষ লক্ষ নিম্নবর্ণ নিম্নবর্গ বাস্তুহারা মানুষ, যারা ওপার বাংলায় সতোর সাথে কায়িকশ্রমে দিনগুজরান করতে বাধ্য ছিল সেই সব মানুষ যারা দেশ ছেড়ে এসেছেশূন্যহাতে তারা নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল রিফিউজি ক্যাম্পে। কারণ কোথাও কোন জবরদখল কলোনিতে নীচু জাত হবার অপরাধে এদের জন্য কোন প্লট দেবার নিয়ম ছিল না। ওই সব কলোনি স্থাপনার প্রাথমিক শর্ত এই ছিল–”এখানে শিক্ষিত ভদ্রলোক ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।” নীচু জাতির কোন কোন সচ্ছল শিক্ষিত মহাশয় নামধাম গোপন করে বিত্তের জোরে কোন কোন কলোনিতে ঢুকে টিকে গেছেন। কেউ কেউ আবার আসল নাম পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে গলাধাক্কা খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এই কারণে কলকাতা এবং তার আশেপাশে গড়ে ওঠা ১৪৯টি জবরদখল কলোনির একটাতেও একটি নমঃশূদ্র জেলে মুচি পরিবার পাওয়া যাবে না। যদি পাওয়া যায়, জানা যাবে সে পরিবার এসেছে অনেক পরে।
বামুন কায়েত বদ্যিরা তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যে বুদ্ধিমান হয়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং আত্মস্বার্থ ভালো বোঝে! তারা সেই উথালপাথাল অস্থির সময়ে খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে একাধিক কলোনিতে প্লট দখল করে রেখেছিল। এ নিয়ে অনেক সময় দখলকারি এক কলোনির লোকের সাথে আর এক কলোনির লোকের তুমুল মারামারি পর্যন্ত হয়ে যেত। যার অনেকগুলোকে জমিদারের গুণ্ডাবাহিনীর হামলা বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। অবস্থা কিছুটা শান্ত হয়ে গেলে দুচার বছর বাদে, নিজের পছন্দমত একটা প্লট দখলে রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দেয়। তখন আর ক্রেতার জাতপাতের ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা থাকে না। মাথায় ঘোরে দরদামের বাস্তব ব্যাপারটা। এই কারণেই নিচুজাতের কিছু পয়সাওয়ালা লোক কলোনিতে প্রবেশ পেয়ে যায়। আর এইভাবে জমি বিক্রি করে বহু কলোনিবাসী হঠাৎ লাখপতি হবার সুযোগ পায়। এইসব ভাগ্যবানের বাইরে ক্যাম্পবাসী যে হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ নিম্নবর্ণ যাদের শিক্ষাদীক্ষা নেই, পেটে ভাত পরিধানে ত্যানা নেই, যাদের হয়ে কথা বলার মতো কোন রাজনৈতিক মুরুব্বিও নেই, এরা কোথায় যাবে। এরা তো সেই মানুষ যাদের দিয়ে দেশের কোন মঙ্গল হবার নয়। বলতে গেলে এরা সব দেশের কাছে–উদ্বৃত্ত অপাঙক্তেয় আবর্জনা বিশেষ কোথায় নিয়ে ফেলা হবে এগুলোকে? সদ্য ক্ষমতা হাতে পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ প্রাণভরে উপভোগ করতে চেটেপুটে খাবার সুযোগ পাওয়া রাজনেতাদের কাছে এ সময়ে এটা যেন গোঁদের উপর বিষফোঁড়া।