যদি আলতা আর চুনজলে রোগ সেরে যায়, রোগী তো বেঁচে উঠবে কিন্তু মরে যাবে হাজার বছর ধরে হাজার মানব দরদি চিকিৎসকদের বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলা চিকিৎসাশাস্ত্র। এই যে এত সব নামিদামি ডিগ্রিধারী ডাক্তার বড় বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, এত ওষুধ পত্র মেশিন যন্ত্র সব ফালতু, বেকার, মিথ্যে হয়ে যায়। তাই রোগীরা মরে যেত। মরে যেত এই বিশ্বাস নিয়ে যে বিনা চিকিৎসায় মরছি না। এম.বি.বি.এস. ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে মরছি।
ক্যাম্পের শিশুরা যাদের বয়েস সাতআট বছরের নিচে, সেই বাচ্চাগুলোই মারা যাচ্ছিল সবচেয়ে বেশি। তখন এমন রাত খুবই কম আসত যে দিন ক্যাম্পের কোন না কোন তাঁবু থেকে সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা কাতর কান্না শোনা না যেত।–”ওরে সোনা মানিকরে আমার, মায়রে ফালাইয়া কই গেলিরে বাবা।” সে কান্নায় সারা ক্যাম্পের আকাশ বাতাস বেদনাতুর হয়ে উঠত। ওই রকম আর্তকান্নার সময়ে অন্ধকার হাতড়ে মা আমাদের দুইভাইকে বুকের মধ্যে চেপে ধরতেন। বিড়বিড় করে তার ইষ্টদেবতাকে ডাকতেন। গ্রামবাংলার সরল মমতাময়ী মা ভক্তি বিশ্বাসে বুঝি এই রকম ভাবত যে তার বুকে থেকে যমরাজ তার সন্তানকে কেড়ে নিতে পারবে না।
ধর্ম বিশ্বাসী মায়ের সে বিশ্বাস টাল খেয়ে গেল একদিন। যেদিন শমনের সমন এসে পৌঁছল আমার কাছে। “চলরে ভোলা, খোল রে ভেলা, সাঙ্গ হল ভবের খেলা।” ছোট্ট পেটটা আমার জয়ঢাকের মতো ফুলেফেঁপে উঠল, সেই সাথে ধুম জ্বর, মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। একদিন পরে শুরু হল পাতলা পায়খানা। দিন দুয়েক পরে পায়খানার সাথে কাঁচা রক্তের স্রোত। এর ওপর পেটের মধ্যে নাড়িছেঁড়া যন্ত্রণা। দিন পাঁচ সাতেকের মধ্যে গোড়া কাটা পুইগাছের মতো নেতিয়ে পড়লাম আমি। অবসন্ন হয়ে গেল সারা শরীর। তখন আর বিছানা ছেড়ে ওঠবার উপায় রইল না। শুয়ে শুয়েই মলমূত্র ত্যাগ। দিনে দশ পনের বিশবার। তখন কেঁৎ পাড়লেই কাজুফুলের মত মলভাণ্ডটা গুহ্যদ্বার থেকে বাইরে বের হয়ে আসছে। সেটা মা বা দিদিমা হাত দিয়ে ঠেলে ভিতরে যতক্ষণ না ঢুকিয়ে দিচ্ছে, ঝুলে থাকছে বাইরে।
আমার এখন মনে নেই দশ না পনের দিন এইভাবে রোগভোগের পর শেষ পর্যন্ত ‘মারা’ গিয়েছিলাম আমি। আমাদের জাতের লোক মৃত শিশুদের পোড়ায় না। তা ছাড়া সেই সময় এত বয়স্ক মানুষ মারা যাচ্ছিল যে জঙ্গলে শুকনো কাঠের আকাল পড়ে গিয়েছিল। তাই বন্দোবস্ত হয়েছিল আমাকে “গোর” দেবার। পূর্ববঙ্গ থেকে পলাতক এই সব মানুষ আসবার সময় সাথে করে অনেক দামি দরকারি জিনিসপত্রই নিয়ে আসতে পারে নি। সব ফেলে রেখে এসেছে। তবে আর শাবল কোদালের মত জিনিস বয়ে আনবে কী করে। রিফিউজিদের সুবিধার্থে সদাশয় সরকার সে সব যোগাড় করে ক্যাম্প অফিসে রেখে দিয়েছে। একটা কী! একসাথে দশটা মারা গেলেও মাটি দেবার সাজ সরঞ্জামে ঘাটতি পড়বে না।
আমাদের কয়েকজন প্রতিবেশী অফিসে গিয়ে শাবল কোদাল সব নিয়েও এসেছিল। আমি মারা গিয়েছিলাম সন্ধ্যার বেশ কিছু সময় পরে। ফলে তাদের তখন আর গোরস্থানে যাবার ইচ্ছা হয়নি। শাবল কোদাল গুছিয়ে রেখে বসেছিল রাতটা শেষ হবার অপেক্ষায়। তাদের ইচ্ছা ছিল, সকাল হবার সাথে সাথে আমাকে নিয়ে চলে যাবে, আর রোদের তেজ বাড়বার আগেই কাজ সেরে ফিরে আসবে। এবার এই কোন সে অলৌকিক অবিশ্বাস্য অসম্ভব কাণ্ড আমার তা জানা নেই, মায়ের মুখে শুনেছি, সন্ধ্যে রাতে মরে গিয়ে, সারারাত মৃত থেকে ভোরবেলা যখন মোরগ ডাক দেয়, পুণর্জন্ম হয়েছিল আমার। নড়েচড়ে উঠেছিলাম আমি। বেলা যত বাড়ছিল, আমার শরীরে একটু একটু করে প্রকাশ পাচ্ছিল প্রাণের স্পন্দন। এবং এক সপ্তাহের মধ্যে আমি রোগ মুক্ত হয়ে গিয়ে সুস্থ হয়ে যাই।
এই শিরোমণিপুর ক্যাম্প কতদিনের পুরনো সে আমি জানি না। তবে আমরা এখানে এসেছিলাম যখন সেটা মনে হয় ১৯৫৩-৫৪ সাল হবে। তার প্রায় এক দুবছর ধরে সারা ক্যাম্প জুড়ে প্রবল দাপাদাপির পর মৃত্যুর দেবতা দয়া করে অসহায় মানুষগুলোকে একটু রেহাই দিয়েছিল। কথায় বলে, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাহা সয়। তখন রিফিউজিদের এখানকার পচা পোকা ধুলো কঁকর যুক্ত চাল ডাল, এখানকার জল হাওয়া রোদ মাটি সব সয়ে নেবার ক্ষমতা বেড়ে গেছে। মানুষ আর অত অল্পে কাতর হচ্ছে না, পোঁকা মাকড়ের মতো মরছে না।
এবার আমার বাবার শখ হল আমাকে চক্ষুম্মান বানাবেন। অর্থাৎ লেখাপড়া শেখাবেন। যে লেখাপড়া জানে না সে চোখ থাকতেও অন্ধ। অন্ধ এক বাপ তার ছেলেকে আর অন্ধ রাখতে চাননা। অন্ধত্বের যে কী কষ্ট তা তিনি মর্মে মর্মে জানেন। লেখাপড়া জানা বাবুদের কাছে যদি কখনো একটা সামান্য চিঠিও পড়ে শোনাবার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, এক প্রহর বেগার না খাঁটিয়ে কিছুতে সে চিঠি পড়ে শোনাবে না।
পূর্ববঙ্গে গরিব-নিম্নবর্ণের মানুষের লেখাপড়া শেখবার তেমন বিশেষ একটা সুযোগ সুবিধা হাতের নাগালে ছিল না। ইচ্ছা থাকলেই তারা লেখাপড়া শিখতে পারত না। এখানে সেই সুযোগ আছে। ক্যাম্পের মধ্যেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটা প্রাইমারি স্কুল খোলা হয়েছে। সারা ক্যাম্পের বালক বালিকারা এখানে পড়ে।
যেদিন আমাকে স্কুলে ভর্তি করার মনোবাসনা, তার দিন সাত আট আগে থেকে শুরু হয়েছিল তার প্রস্তুতি। বাবা চলে গিয়েছিলেন খুঁজতে কোথায় তালগাছ ও বাঁশঝাড় আছে। শিশুশিক্ষায় এই দুটোর অবদান অসামান্য। তালগাছ পেয়ে তরতর করে বাবা চড়ে গিয়ে ছিলেন তার মাথায়। আর সেখান থেকে বেছে বেছে নামিয়ে এনেছিলেন একগোছা তালপাতা। এরপর বাঁশ বাগানে গিয়ে কেটে এনেছিলেন দুখানা কঞ্চি। একখানা বিঘত খানেক ছোট আর একখানা হাত দেড়েক বড়। ছোটখানার মাথা থেঁতো করে হবে কলম, আর বড়খানা হবে বেত। আমি পড়া না পারলে যা দিয়ে মাষ্টার আমার ছাল তুলবে। বাবা খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করেছেন যে, বাচ্চারা পড়া না পারলে মাষ্টার মারবার জন্য তাকেই ঢোলকমলির লাঠি ভেঙে আনতে বলে জঙ্গলে পাঠায়। বাবার বিচারে এটা ঠিক নয়, বনে জঙ্গলে সাপ বিছে থাকতে পারে। তারা যদি কামড়ায় বাচ্চার লঘুদোষে গুরুদণ্ড হয়ে যাবে। বাবা তাই শক্তপোক্ত একটা লাঠি নিজেই দিয়ে দেবেন আমার কাছে। ঢোলকমলি ভাঙবার সেই ভয়াবহ মুহূর্ত এলে আমি যেন সেটা মাষ্টারের শ্রীহস্তে অৰ্পণ করি।