বাবা ডোল পেত যখন তখনও সেই ফুটো পয়সার প্রচলন ছিল, আমাকে একটা পয়সা দিতেন। মা তাকে গেথে দিতেন কোমরের তাগায়। বলে দিতেন এই পয়সা যেন খরচ না করি। যেন জমিয়ে রাখি কোন এক পুজো পার্বণ আনন্দের দিনে খরচা করবার জন্য। না হলে সবাই যখন খাবার কিনবে, খাবে, আমার তখন লোকের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে।
ডোল পাবার পরেরদিন বাবা ক্যাম্প অফিসে জানিয়ে এক বেলার ছুটি নিয়ে বিষ্ণুপুরের চক বাজারে বাজার করতে চলে যেতেন। সেইদিন আমাদের মাছের ঝোল, আর ভাল চালের ভাত পেট ভরে খাওয়া হোত। চৌদ্দদিনের পঁচা পোকা কাঁকর পাথর খাওয়া মুখে সেদিন যেন অমৃত বর্ষা হোত। ক্যাম্পের সরকারি গুদাম থেকে আমাদের “ভোল” বাবদ যে চাল ডাল দেওয়া হোত ধুলো ময়লা কাকরে মাখামাখি সে চাল যে কতকালের পুরনো তা কে জানে। কেউ কেউ বলত এ চাল নাকি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর জন্য গুদামজাত করে রাখা হয়েছিল, দশ বারো বছরে যা পঁচে গোবর হয়ে গেছে। সে চালে ভাত রান্না করলে কেমন একটা টকটক বোটকা গন্ধ বের হোত। কেরোসিন তেল তো ছিল না। সারা ক্যাম্পের বেশির ভাগ তাঁবুতে কেরোসিনের অভাবে সূর্য ডোবার আগে রাতের রান্নাখাওয়া সেরে ফেলা হোত। এত তাঁবুতে এক সাথে ভাত রান্না হবার ফলে সেই বোটকা গন্ধে সারা অঞ্চল প্লাবিত হয়ে যেত।
এই চালের ভাত খাওয়ার ফলে প্রথম প্রথম কিছুদিন সবারই পেট পেট গুঢ় করত। জলের মতো পাতলা পায়খানা হোত। ক্যাম্পের ভিতর কোন পায়খানার ব্যবস্থা ছিল না। সবাইকে সে কাজ সারতে যেতে হোত বনে বাদারে মাঠে জঙ্গলে। যারা সুস্থ মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা সূর্য ওঠার আগে বা সূর্য ডোবার পরে একর্ম সেরে নিত। তবে যাদের পেট খারাপ-পাতলা পায়খানা হচ্ছে, সে আর অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা কী করে করবে, দুরের মাঠে বা কেমন করে যাবে! সে বসে পড়ত তাবুর আড়ালে। যার ফলে ক্যাম্পের চারদিকে জমে গিয়েছিল মলমূত্রের মহাসাগর। পথ চলবার সময়ে সতর্কভাবে পা না ফেললে বিষ্ঠা মাড়িয়ে দেবার সম্ভাবনা ছিল বড় প্রবল। আর এটা আমাদের অর্থাৎ শিশুদের প্রায়ই হয়ে যেত।
এই অখাদ্য চাল ডাল খেয়ে মানুষের নানাবিধ পেটের রোগ, তার উপর ছিল অসহ্য গরম। জলবিহীন শুষ্ক গরম জেলা যেখানে এই সময় “লু” বাতাস বয়। সে বাতাসে যেন আগুনের হল্কা যা শরীরে লাগলে চামড়া ঝলসে যায়। তখন দুপুর হলে মনে হতো আমাদের চারিপার্শ্বে যেন দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। সূর্যের শরীর থেকে ছুটে আসা তপ্ত রশ্মিকণা মাটিতে আঘাত করে আবার কেঁপে কেঁপে উপরের দিকে উঠতে থাকত। তখন খালি পা মাটিতে রাখা যেত না। মনে হোত মাটি যেন রুটি সেঁকা চাটুর মতো উত্তপ্ত। এখানকার সব মানুষই নদী মাতৃক দেশ পূর্ববাংলার অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আজন্ম লালিত পালিত। তারা হঠাৎ ভাগ্য বিপর্যয়ে এমন শুষ্ক নীরস কঠিন মাটিতে আছড়ে পড়ে, সব যেন জলবিহীন মাছের মত ছটফট করে মরছিল।
এমনিতে তো নির্দয় আকাশ আগুন ঢালছে, সে আগুন আবার এসে পড়ছে মোম মাখানো ত্রিপলের ওপর। যার ফলে তাঁবুর মধ্যে তাপমাত্রা চতুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। এই অসহনীয় অবস্থায় বেশ কয়েক মাস ধরে ক্যাম্পে মৃত্যুর হার অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছিল। যেন মড়ক লেগে গিয়েছিল সারা ক্যাম্প জুড়ে। আমাদের সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে অনবরত চলছিল অন্তহীন এক মৃত্যুর মিছিল। একটি মৃতদেহ দাহ করে ফিরে এসে লোজন আর একটা মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার প্রস্তুতি শুরু করে দিত।
ক্যাম্পের মাঝখান থেকে যে রাস্তাটা পুবদিকে চলে গেছে মাইলটাক সামনে গেলে ছিল একটা ছোট্ট ডোবা। এখানেই দাহকরা হোত সব মৃতদেহ। দিনরাত সেখানে চিতা জ্বলতমড়াপোড়া ধোয়ায় ঢেকে যেত আকাশ। এই সব মানুষের মধ্যে বৃদ্ধ বৃদ্ধা ও শিশু মৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে দাহ করা হোত শুধু বয়স্কদের। শিশুদের দেওয়া হত মাটি চাপা।
ক্যাম্পে তখন বার্ডফ্লু রোগ লাগা মুরগির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মারা যাচ্ছে আর সদাশয় সরকার বাহাদুর কী করছে? তবে কী ক্যাম্পে ন্যুনতম কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না? না, না, মহান ভারত সরকারের মহান মন্ত্রী আমলাদের এমন অপবাদ মরে ভুত হওয়া লোকজনও দিতে পারবে না। রীতিমত উত্তমকুমারের মত সুদর্শন, চুলে ঢেউ তোলা একজন ডাক্তার ছিল। তার চোখে দামি চশমা, মাথায় ইংরেজদের মত টুপি ছিল। মালার মত গলায় ঝোলাবার জন্য ছিল একটা স্টেথেস্কোপ, আর চড়বার জন্য ছিল টুংটাং বেল বাজানো সাইকেল। শুধু তার কাছে ছিল না সেই প্রাণদায়ী ওষুধ যা খেলে রোগী রোগমুক্ত হয়।
সে আর ও বেচারার কী দোষ। সে তো বার বার সরকারের হেলথ ডিপার্টমেন্টে–ওকে কী বলে, রিকুইজেসান পাঠিয়েছে, তারা যদি ওষুধপত্র না পাঠায় ডাক্তার আর কী করবে? ডাক্তারের কাছে ওষুধ বলতে ছিল স্রেফ দু রকম জল। যার একটা মেয়েদের পায়ে পড়বার আলতার মত লাল। আর একটা চুনগোলা জলের মতো সাদা পদার্থ। সর্দিকাশি জ্বরজারি মাথাব্যথা পেটব্যথা আমাশয়, দাস্ত থেকে শুরু করে টাইফয়েড টিবি কলেরা জন্ডিস–সব রোগের এক দাওয়াই ওই সাদা জল দিনে তিনবার। আর কাটা ফাটা পোড়াফোঁড়া সব রোগের জন্য ওই লাল রঙ দিনে দুবার।