এ কী অমানবিক বিধান হিন্দুধর্মে? যে মানুষটা কাল পর্যন্ত ছিল আমার প্রতিবেশী, আত্মীয়, আপনজন, আজ সে যে কোন কারণে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে গেছে বলে অচ্ছুত অস্পৃশ্য! সে যদি আমার উঠোনে এসে দাঁড়ায় কোন দরকারে, তো আমার উঠোনের মাটি অপবিত্র হয়ে যাবে! আর সেই মাটিকে পবিত্র করবার জন্য ছেটাতে হবে গরুর পায়খানা গোলা জল! সে যদি আমাকে ছুঁয়ে দেয়, স্নান করতে হবে শুদ্ধ হবার জন্য। অথচ বিষ্টাভোজী এক কুকুরের বাচ্চার জন্য এসব কিছুই করবার দরকার নেই। সে ইচ্ছা করলে আমার বিছানায়ও শুতে পারে। এই অপমান-অমানবিক বিধানের বিরুদ্ধে যে খেপে না ওঠে সে তো মনুষ্যপদবাচ্যই নয়। ওই একই ধরনের অপমান, ঘৃণা হিন্দুধর্মের উচ্চবর্ণের নিকট থেকে নমঃশূদ্ররাও পেয়ে থাকে। তাকে ছুঁয়েও ওরা চান করে, উঠোনে দাঁড়ালে গোবর জল ছেটায়। সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নমঃশূদ্ররা তেমন কোন তীব্র প্রতিবাদ করতে পারেনি। কিন্তু মুসলমানরা পেরেছে। খেপে গেছে তারা, যে ধর্ম-যে মানুষ আমাদের ঘৃণা করে আমরা আর তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রাজি নই।
এই কারণে পুর্ব পাকিস্থান থেকে ভয়ে আতংকে–অসুরক্ষায়, ভিটে মাটির মায়া ছেড়ে, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল মানুষ “ইন্ডিয়া” নামক এক অচেনা ভূভাগের দিকে। যারা শিক্ষিত, আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল, সমাজের মাথা, উচ্চবর্ণের লোক তাদের প্রায় সবাই পালিয়েছে সবার আগে। যে দু পাঁচ জন আছে তারাও সব পালাই পালাই করছে। এই অবস্থায় যারা নির্ধন নিম্নবর্ণ নিম্নবর্গ তারা সেদেশে বাস করবে কোন সাহসে?
আমার বাবার মোটেই দেশত্যাগ করে আসবার ইচ্ছা ছিল না। মায়ের মুখে শুনেছিমুসলমানদের সাথে তার বেশ সুসম্পর্কই ছিল। তারা বাবাকে দেশে থেকে যাবার জন্য অনুরোধও করেছিল, “থাহো তুমি, দেহি কোন হালায় তোমার কী ছেড়ে।” কিন্তু বাবা তাদের অনুরোধ রাখতে পারেননি। আমাদের জ্যেঠাকাকা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী প্রায় সবাই ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। ভাঙা দেশে ভাঙা মন নিয়ে দুরুদুরু বুকে বাবা কেমন করে বাস করবেন! তাই একদিন স্ত্রী পুত্রের হাত ধরে রওনা দিয়েছিলেন এপাড় বাংলায়।
আমার তখন সঠিক বয়েস কত জানি না। তবে একদিন আমাদের ঘরের সামনের গাঙপাড়ের রাস্তা ধরে জনা কয়েক লোক ভোটের প্রচার করতে শ্লোগান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল–সেটা মনে আছে। “ভোট দেবেন কাকে, চিত্ত সুতার কে”! কে সেই চিত্ত সুতার, তিনি কোন পার্টির লোক, আমার সে সব জানা নেই, তবে আমার পরের যে ভাই, আর নাম রাখা হয়েছিল সেই নেতার নামে চিত্ত, চিত্তরঞ্জন।
মা বাবা আমি আমার ভাই চিত্ত এবং একমাত্র মেয়ের মায়া ত্যাগ করতে না পারা আমাদের বুড়ি দিদিমা এই পাঁচজন একদিন এসে পৌঁছেছিলাম এই দেশে–“মহান দেশ ভারতবর্ষে।”
এপাড় বাংলায় এসে আমাদের বেশ কয়েকটা দিন কাটাতে হয় শিয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফর্মে। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বাঁকুড়া জেলার শিরোমণিপুর ক্যাম্পে। এখানে আমরা আসবার অনেক আগে এনে রাখা হয়েছে আমাদের মতো আরও কয়েক হাজার পরিবার। বিশাল একটা মাঠে সার সার খাটালে আছে লাল লাল ত্রিপলের ছাউনি। হাত আটেক লম্বা হাত ছয়েক চওড়া সেই তাঁবুর মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয়েছে পাঁচ ছয় সাত সদস্যের এক একটা পরিবার।
শিরোমণিপুর ক্যাম্পের ঠিক মাঝখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে উত্তর থেকে সোজা দক্ষিণে। ক্যাম্পবাসীরা নিজেদের সুবিধার জন্য পুবদিকের অংশের নাম রেখেছিল আমবাগান। কেননা এখানে কিছু আমগাছ ছিল। আর পশ্চিম প্রান্তের নাম দিয়েছিল শালবাগান। বলাবাহুল্য এখানে ফরেষ্ট বিভাগ দ্বারা রোপিত একটি শালবন আছে। আমাদের তাবু পড়েছিল আমবাগানে।
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বাঁকুড়া একটি খরাপ্রধান উষ্ণ জেলা। যে সময়ে আমাদের এখানে আনা হয় সেটা গ্রীষ্মকাল। প্রখর দাবদাহে তখন চারিদিক যেন জ্বলে যাচ্ছে। ক্যাম্পে তখন মানুষের জলকষ্ট ছিল বড় প্রবল। আম ও শাল দুই বাগানের লোকের জলের প্রয়োজন মেটাবার জন্য সদাশয় সরকার বাহাদুরের পক্ষ থেকে বসানো হয় দুটো টিউবয়েল। এ ছাড়া জলের আর কোন জোগানের পথ ছিল না। ফলে জলের কলের সামনে সারাদিনই মহিলাদের লম্বা লাইন লেগে থাকতো। এক দু ঘন্টা লাইন দিয়ে যে এক দু বালতি জল যোগাড় হোত সেই দিয়ে রান্না খাওয়া বাসন ধোওয়া চান সব কিছু।
এখন আর সঠিক পরিমাণটা মনে নেই তবে মনে আছে, প্রতি চৌদ্দদিন অন্তর আমাদের কিছু চাল ডাল দেওয়া হোত সরকারি গুদাম থেকে। একে বলা হোত ডোল। দেওয়া হোত মাথা পিছু কিছু নগদ টাকা। আমাদের পাঁচজনের পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত সে অর্থের পরিমাণ ছিল কুড়ি টাকা তের আনা। তের আনা মানে একাশি পয়সা। আমরা যে বছর এখানে আসি তখনও দশমিক মুদ্রার প্রচলন হয়নি। সেটা হয়েছিল এক দুবছর পরে। তবে মানুষ তখনও পুরানো হিসাবে “আনার” হিসাবই করত। ছয় নয়া পয়সায় এক আনা বারো নয়া পয়সায় দু আনা। আবার পঁচিশ পয়সায় চার আনা। এক আনা সের পুইশাক। একই দোকান থেকে চার সের কিনলে এক পয়সা বেশি যায় বলে আমাদের পাশের তাবুর রাইচরণ দুসের দুসের করে দুই দোকান থেকে কিনে এক পয়সা বাঁচিয়ে নিত। বাবার মাথায় কোনদিন সে বুদ্ধি আসেনি।