ছোট ভাইয়ের সঙ্গী সাথী ছিল সাত আটজন। যাদের মনে ভরত কাঠির স্মৃতি আতংক তখনও বড় টাটকা। ছোট ভাইয়ের রোগ দেখে সবার বুকে জেগে উঠল মৃত্যু ভয়। প্রাণ বড় মূল্যবান বস্তু। সে একবার যদি যায় আর ফেরে না। “আমি মরে গেলে আমার বউ বাচ্চার প্রতিপালন কে করবে।” অবশেষে তারা যুক্তি পরামর্শ করে মৃতপ্রায় ছোটভাইকে সেই গাছতলায় ফেলে যে যার প্রাণ নিয়ে পালিয়ে চলে এল এবং গ্রামে এসে বলে দিল, সে মারা গেছে।
যে রোগের কবলে সে পড়েছিল বিনা চিকিৎসায় বিনা সেবা শুশ্রূষায় মারা যাবারই কথা। সেটা হলে ভালই হোত অনেক বড় বিপদের সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পেত এখানকার মানুষ। কিন্তু সে মারা গেল না। এক মুসলমান ভোরবেলা যাচ্ছিলেন ফজরের নমাজ পড়তে। তার চোখে পড়ে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষটা একা মরছে না তার সাথে মারা যাচ্ছে মানব সমাজের মনুষত্ব, বিবেক দয়া মায়া মানবিকতা সব কিছু। তার আর নমাজ পড়তে যাওয়া হল না। ছোট ভাইকে তুলে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে, এবং দীর্ঘ সেবা শুশ্রূষায় সুস্থ করে তুললেন তাকে। এরপর যেদিন সে নিজের গ্রামে ফিরে এল ততদিনে দুই দাদা শ্রাদ্ধশান্তি সেরে ফেলেছে তার।
যারা তাকে ফেলে গিয়েছিল তারা তো গ্রামে গিয়ে এই কথাই বলেছিল যে সে মারা গেছে। এখন সে জীবিত ফিরে আসায় সারা অঞ্চলে হৈ চৈ পড়ে গেল। দুটো পক্ষ হয়ে গেল গ্রামে। একদল বলল-এভাবে ফেলে এসে মিথ্যা কথা বলাটা ঘোরতর অন্যায়। আর একদল বলল, না, কোন অন্যায় নয়। একজনার জন্য কী পাঁচজন মরবে! এই নিয়ে বেঁধে গেল দুপক্ষের ঝগড়া লড়াই কঁজিয়া। এরপর গ্রাম সভায় বিচার গেল। গ্রাম্য মাতব্বরগণ বিচার করে, যারা ছোটভাইকে ফেলে এসেছিল তাদের দোষী সাব্যস্থ করে মোটা অংকের টাকা জরিমানা করলেন।
এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। হঠাৎ একদিন দূর দেশের সেই মুসলমান লোকটি কয়েকজন সঙ্গীসাথী নিয়ে খোঁজ খবর নিতে চলে এল ছোট ভাইয়ের। তখন গ্রামের সবাই জেনে গেল যে সে মুসলমানের অন্নজল খেয়ে বেঁচে এসেছে। এ যেন সেই লালন ফকিরের প্রাণে বাঁচার মতো আর এক ঘটনা। তখন সেই জরিমানা দেওয়া লোকেরা প্রতিহিংসাবশতঃ গিয়ে হাজির হল গ্রামের মাতব্বরদের দরজায়–“আমরা যা দোষ করছি তার জইন্য আপনেরা দশজোনে যা সাজা দিছেন আমরা মাতা পাইত্যা নিছি। এইবার আপনেরা ছোডোর বিচার করেন। হে যে মিয়াগো ঘরে ভাতগোস্ত খাইয়া আইছে তার কী হইবে”।
তখনকার গ্রামবাংলার বিচার ব্যবস্থা বড় কঠোর। জাতধর্ম রক্ষার জন্য ভীষণরকম নির্দয়। তাদের বিবেচনায়, আগুনে যে হাত দেয়, সে জেনে দিক আর না জেনে, হাত তো পুড়বেই। “ছোট” মুসলমানের অন্নজল খেয়েছে, সে বুঝে খাক আর না বুঝে, এর বিচার তো হবেই। ছেড়ে দেবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। জাত ধর্ম বলে কথা! তাই বিচার হল অপরাধীর। সমাজপতিরা রায় দিল সে জাতি দ্রুত ম্লেচ্ছ, বিধর্মী হয়ে গেছে। আর তার সুমহান সনাতন ধর্মে কোন স্থান নেই। ফলে আমার সেই ঠাকুরদাকে জাত খুইয়ে “খেড়ে” হয়ে যেতে হল। যারা সরাসরি হিন্দু থেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে, তাদের বলা হয় খেড়ে। আর যারা বৌদ্ধধর্ম থেকে মুসলমান হয় তারা নেড়ে বলে চিহ্নিত হয় হিন্দু সমাজে।
সেদিন সে ছিল সারা গ্রামে একেবারে একা এবং অসহায় এক মানুষ। পরবর্তী কালে দিনে দিনে নানাভাবে “জাতমারা” যাওয়া লোকের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়ে গেছে তাদের অন্য গ্রামের একই ধরনের লোকজনদের সাথে ঘনিষ্টতা। ধর্মীয় নিপীড়ন যাদের বেঁধেছে একসূত্রে।
প্রথম দিকে যারা সংখ্যায় ছিল কম এবং সামাজিক দিক থেকে খুবই দুর্বল; কারণ হিন্দুরা তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু ধর্মীয় বিধি পালন না করার জন্য মুসলমানরাও কাছে টেনে নেয়নি। বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম এবং অন্যান্য মুসলমান ভাইদের সাহস ও সহযোগিতায় তারা এসময়ে ভীষণ রকম বলবান। তারা যে কোনদিন হিন্দুধর্মের অতীত-অন্যায় অবিচারের প্রতিশোধ নিতে ক্রদ্ধ হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যুগ যুগান্তের সঞ্চিত ক্রোধে যদি একবার বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে সে যে কতখানি নির্মম আর বিভৎস হতে পারে তারই বোধহয় প্রকৃষ্ট উদাহরণ “মুলাদির রায়ট”।
সেখানকার এক ইস্কুলে আশ্রয় নিয়ে ছিল প্রায় চারশো দাঙ্গায় ঘর পোড়া প্রাণভয়ে ভীত নরনারী শিশুবৃদ্ধ। পালাবার সব পথ বন্ধ করে দিয়ে তাদের সারারাত ধরে একে একে জবাই করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। শোনা যায়, এখানে ঘাতকেরা নাকি পায়ে নুপুর বেঁধে নেচে নেচে মানুষ কেটে ছিল। কে বলতে পারে যে তুষখালি, পিরিচপুর, জালোকাঠি, নাজিরপুর, এসব অঞ্চলেও একদিন দাঙ্গা হবে না!
দাঙ্গা! দু অক্ষরের ছোট্ট এই শব্দটার মধ্যে লুকোনো আছে সেই ভয়ংকর মারণ বিষ যা মানুষকে বোধবুদ্ধি বিচার বিবেচনা হীন একটা পাগলা কুকুর তুল্য জীবে পরিণত করে দেয়। যার কাছে তখন দয়ামায়া স্নেহমমতা আশা করা বৃথা।
তুষখালি অঞ্চলে আগে কোনদিন কোন মুসলমান ছিল না। শুধু এখানে কেন, অনেক অঞ্চলেই ছিল না। দুই বাংলা এক করলে জনসংখ্যার নিরিখে এখন হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। এরা কেউ ইরাক ইরান সৌদিআরব থেকে আসেনি। সব এই দেশের মানুষ, যাদের পূর্ব পুরুষরা ছিল হিন্দু। এদের একটা বড় অংশ জন্ম নিয়েছে অসহিষ্ণু হিন্দু ধর্মের সংরক্ষকদের ভুল ভ্রান্তির ফাঁক ফোকর থেকে। এখন সেই বিষবৃক্ষের বিষময় ফল ফলতে শুরু করেছে। শত শত বছরের অপমান অবমাননার বদলা নিতে রক্তখেলায় নেমে পড়েছে চির অপমানিতের দল।