দু’হাজার পৃষ্ঠার বই যিনি লিখেছেন তিনি তাঁর বই লেখার কাজটাকে ভাগ ভাগ করে নিয়ে নিয়মিত রোজ কিছু কিছু করে লিখেছেন। অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়নি তাঁকে।
অথচ বইটি দেখে আপনি আঁৎকে উঠে বলেছিলেন, আপনার দ্বারা ওই রকম একটা বই লেখা কক্ষনো সম্ভব নয়। কেন বলেছিলেন কথাটা বলুন তো?
বইটার সম্পূর্ণ রূপ দেখে বলেছিলেন। বইটার সম্পূর্ণ চেহারাখানা এতো বিরাট যে দেখামাত্র ভয় লাগে, বাপরে! এতো বড়! আসলে কিন্তু যতো বড় মনে হয় ততোবড় হয়েও অতোবড় নয়, যদি আপনি বইটিকে ভাগ ভাগ করে দেখে নিতে জানেন।
.
দেখার চোখ
সবাই আমরা দেখতে পাই, চোখ যখন আছে, কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব কম। লোকই পর্যবেক্ষণ করে।
বলতে পারবেন, এক টাকার কাগুঁজে নোটের কোন্ পিঠের কোন্ খানটায় লেখা আছে ওয়ান টাকা?
পাসপোর্ট করা দরকার আপনার। অফিসের সহকারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসটা কোথায় জানো?’
সহকারী বললো, ‘কি আশ্চর্য! আপনি তো, স্যার, অফিসে আসার সময় পাসপোর্ট অফিসের পাশ দিয়েই আসেন।’ এধরনের ঘটনা ঘটেনি আপনার জীবনে?
বেশিরভাগ মানুষই দেখে, কিন্তু পর্যবেক্ষণ করে না।
কেউ কেউ বাগান দেখে, কিন্তু তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বাগানে কি কি ফুল দেখলে? বলতে পারবে না সে। দুটো কারণে সে প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারলো না। এক, কি কি ফুল বাগানে আছে, লক্ষ করেনি সে। দুই, ফুল দেখে থাকলেও ফুলগুলোর নাম জানা নেই তার।
প্রমাণ হলো, এই লোক দেখে, কিন্তু দেখে শেখে না। আরো প্রমাণ হলো, এ লোক খুঁটিয়ে দেখে না।
একটা জিনিসের মূল্য বুঝতে হলে তাকে কেবল সামগ্রিক ভাবে দেখলে চলবে না, তাকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে, তার বৈশিষ্ট্য কি, ত্রুটি কি, বিশেষত্ব কি-সব লক্ষ্য করে জেনে নিতে হবে।
দেখা মানে চোখের সামনে যা কিছু আছে সে-সবের চিত্র গ্রহণ করা। সেই চিত্রগুলোকে স্মরণের মধ্যে রেকর্ড করাকে পর্যবেক্ষণ বলা যেতে পারে।
স্মরণশক্তির মধ্যে যেগুলো রেকর্ড হয়ে রইলো সেগুলো আপনার সচেতনতার অংশ। বিশেষ হয়ে থাকবে।
পর্যবেক্ষণ শক্তি বৃদ্ধি করা যায়। আপনার মধ্যে এই শক্তি বৃদ্ধি পেলে কাম্যবস্তু এবং আপনার মধ্যবর্তী বাধাবিঘ্নগুলোকে সহজেই পরিষ্কারভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন, আড়ালের বাধাটাকেও বহু দূর থেকে আপনি দেখতে পাবেন। তার উপর, কাম্যবস্তুর উপাদান বিভক্তিকরণেও সাহায্য পাবেন।
আপনার চিন্তাভাবনাকে গঠনমূলক করতে হলেও কোনো জিনিসকে কিংবা কোনো বিষয়কে দেখতে হবে পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি নিয়ে।
.
ঘনীভূত মনোযোগ
আপনি যা দেখেন তার একটা নোট রাখা মানে পর্যবেক্ষণ করা। কনসেনট্রেশন বা ঘনীভূত মনোযোগ কাকে বলে? নির্দিষ্ট কোনো অবজেক্ট বা সাবজেক্টের উপর যদি আপনি আপনার চেতনা এবং সজ্ঞান চিন্তা সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করেন, যতোক্ষণ না সাবজেক্ট বা অবজেক্টটি সম্পর্কে আপনার পুরোপুরি ধারণা হচ্ছে–এই অবস্থাকে। ঘনীভূত মনোযোগ বা কনসেনট্রেশন বলা চলে।
কন্সালটিং সাইকোলজিস্টদের কাছে যতো লোক যায়, তাদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন স্বীকার করে যে চিন্তায় ভাবনায় মনোযোগ ঘনীভূত করার ক্ষমতার অভাব রয়েছে তার মধ্যে।
মনোযোগ ঘনীভূত করতে পারা একটা গুণ, কিন্তু ঈশ্বর প্রদত্ত অলৌকিক কিছু নয়। এ গুণের অধিকারী আপনিও হতে পারেন। কথাটা ঠিকভাবে বলা হলো না, আসলে এই গুণের অধিকারী হতেই হবে আপনাকে। আপনার জন্যে এটা ফরয।
‘চিন্তায় বা কাজে মন বসাতে পারি না আমি।’–এই ধরনের নেতিবাচক কথা ভাববেন না বা বলবেন না। আপনি যদি বারবার বলেন, ‘কিছুই মনে রাখতে পারি না আমি।’-দেখবেন, সত্যি সত্যি কিছুই মনে রাখতে পারছেন না। এই নিয়ম সব কিছুতে খাটছে। যা ধরে নিচ্ছেন, ফলাফল তাই ঘটছে।
হাতের কাজ সম্পর্কে বিরূপতাও ঘনীভূত মনোযোগের অভাব ঘটায়। চঞ্চল মন পালাবার চেষ্টা করতে পারে। তাই, কাজটাকে আগে পছন্দ করুন। পছন্দসই কাজে মনকে বসাতে হয় না, মনই আপনাকে বসায়।
কুঁড়েমির কারণেও ঘনীভূত মনোযোগর অভাব ঘটা বিচিত্র নয়। কিন্তু কেউ যদি আনন্দদায়ক কোনো কাজ করে, কুঁড়েমি আসতেই পারে না তার মধ্যে। এক্ষেত্রেও ওষুধ ওটাই: আনন্দ দেয় যে কাজ সেই কাজ করুন।
নিজেকে অযোগ্য বলে মনে করলে কোনো কাজেই ঘনীভূত মনোযোগ প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না।
.
অনুশীলন
আরামদায়ক একটি চেয়ারে এমন পজিশন নিয়ে বসুন, সামনে ফাঁকা দেয়াল ছাড়া যেন আর কিছু দেখা না যায়। ছোটো একটা টুল বা টেবিল রাখুন নিজের সামনে। টেবিলের উপর রাখুন একটা বই–যে-কোনো বই। এখন আপনার একমাত্র কাজ পাঁচ মিনিটের জন্যে দুনিয়া সম্পর্কে যাবতীয় সব কথা ভুলে যান, ভুলে গিয়ে ভাবুন। শুধুমাত্র বইটার কথা। বইটার দিকে তাকিয়ে বারবার, এটা একটা বই…এটা একটা বই… এটা একটা বই…’ উচ্চারণ করার দরকার নেই। বইটা সম্পর্কে। ভাবুন, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে, যতোরকম ভাবে ইচ্ছা ততোরকম ভাবে। আপনি বইটার বিষয়-সূচী সম্পর্কে ভাবতে পারেন, আকার সম্পর্কে ভাবতে পারেন; রঙ, নাম, কাভার, ডিজাইন, বাঁধাই ইত্যাদি সম্পর্কে যা ইচ্ছা তাই ভাবতে পারেন। বইটা সম্পর্কে ভাববার বিষয়বস্তুর অভাব পড়বে না আপনার। আপনি যদি মুদ্রণ সম্পর্কে মোটামুটি জানেন, তাহলে মানসপটে দেখতে পারেন বইটা ছাপা হচ্ছে। এমনকি আপনি কল্পনার চোখে দেখতে পারেন বইটা ডাকযোগে বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন এজেন্টদের কাছে চলে যাচ্ছে, বিভিন্ন দোকানে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে।