টেবিলের উপর রাখা কাঁচের বাসন-পেয়ালা ভেঙে নিচে পড়বে, থেঁতলে দেবে ভোজনরত অতিথির পায়ের আঙুলগুলো।
বলটা যখন স্থির ছিলো, ওর মধ্যে ছিলো পোটেনশিয়াল এনার্জি। কিন্তু যেই। মাত্র গড়াতে শুরু করলো, ওটা আর পোটেনশিয়াল এনার্জি রইলো না, রূপান্তরিত হলো কাইনেটিক এনার্জিতে।
.
কারণ এবং ফলাফলের আইন
পোটেনশিয়াল এনার্জি সব মানুষের মধ্যেই আছে, আগেই বলেছি। কিন্তু খুব কম মানুষের মধ্যে আছে কাইনেটিক এনার্জি। এর কারণ কি?
যার মধ্যে কাইনেটিক এনার্জি নেই সে নিষ্ক্রিয়, তাই না? প্রশ্নটা তাহলে দাঁড়ালো, মানুষ নিষ্ক্রিয় হয় কেন?
নিষ্ক্রিয়তা, ইংরেজিতে যাকে বলে ইনঅ্যাক্টিভিটি, এর কারণগুলো এখন ব্যাখ্যা করে বুঝে নেয়া যাক।
মেলভিন পাওয়ার বলছেন, নিষ্ক্রিয়তা কারণ নয়, নিষ্ক্রিয়তা ফলাফল। এবং ফলাফল বদলাতে হলে, কারণ বদলাতে হবে।
নিজের সম্পর্কে অনাস্থা, সময়ের অভাব, জ্ঞানের অভাব, অভিজ্ঞতার অভাব, আলস্য-এই পাঁচটির যোগফল হলো নিষ্ক্রিয়তা। মানুষ নিষ্ক্রিয় হয় এই পাঁচটি বিষয়ের কারণেই।
আসুন, পাঁচটি বিষয়কে আলাদা আলাদা ভাবে বিচার করে দেখা যাক নিষ্ক্রিয়তার জন্যে এরা কে কি পরিমাণ দায়ী।
প্রথমে ধরা যাক-নিজের সম্পর্কে অনাস্থা।
আপনার আশপাশে শত শত লোক পাবেন, যারা নিজেদেরকে অযোগ্য বলে মনে করে। যারা রিকশা চালায় তারা কেন আরো ভালো কোনো পেশা বেছে নেবার চেষ্টা করে না? কারণ অন্য কোনো পেশার উপযুক্ত বলে মনে করে না তারা। নিজেদেরকে। অন্য একটি পেশায় ঢোকবার জন্যে যে-সব গুণ এবং উপকরণ থাকা দরকার তা যথেষ্ট পরিমাণে নেই-এই ভুল ধারণাই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষকে উপরে উঠতে দেয় না, সামনে এগোতে দেয় না। তাদের আইডিয়া এবং চিন্তাভাবনারও যে মূল্য আছে, এই উপলব্ধি তাদের মধ্যে আসে না।
প্রমাণিত সত্য হলো, সুস্থ কোনো মানুষের বেলাতেই নিজেকে অযোগ্য বলে মনে করার প্রকৃত কোনো কারণ নেই। এ প্রশ্ন করবেন, তবু অধিকাংশ মানুষ নিজেকে অগ্য বলে মনে করে, নিজের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে না?
কারণটা সাইকোলজিক্যাল। ছোটোবেলায় তাদের মনে যে ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, এ তারই বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
অবিবেচক অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে অহরহ বলে থাকেন, তুমি পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না, তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি এক্কেবারে নেই, ভাঙবে দেখছি গ্লাসটা, তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না, তোমার মাথায় গোবর আছে নাকি, ইত্যাদি। এই ধরনের বক্তব্য বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোনো ছেলে বা মেয়েকে বললে নিজের সম্পর্কে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়ে যায়, আমার দ্বারা সত্যি কিছু হবে না, আমি আসলে বুদ্ধিমান নই।
এইভাবেই ছোটো ছেলের অবচেতন মনকে জানিয়ে দেয়া হয়, সে অযোগ্য। ছেলে যখন বড় হয়, অবচেতন মন তখন তাকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মনে পড়িয়ে দেয় কথাটা, তুমি যোগ্য নও।
নিজের প্রতি অনাস্থাবোধের শিকার কোনো ব্যক্তি চমৎকার সব আইডিয়ার অধিকারী হতে পারে, কিন্তু আইডিয়াগুলোকে বাস্তবরূপ দেবার সময় মুষড়ে পড়বে সে, সন্দেহে ভুগবে, দ্বিধা-সঙ্কোচ বোধ করবে, ভয় পাবে-অযোগ্যতার জন্যে যদি ব্যর্থ হতে হয় এই ভেবে।
জানতে চাইবেন, অনাস্থারোধের মুঠো থেকে মুক্তি পাবার উপায় আছে কিনা।
উপায় আছে। উপায়টা সহজও বটে।
আমি পারবো না, আমার দ্বারা হবে না-এই ধরনের নেতিবাচক চিন্তাভাবনাগুলোকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করলেই সুফল ফলবে। বদলে, ‘এটা পারবো, ওটা পারবো’-এই ধরনের ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে আপনাকে। _ এর আগে বলেছি, আপনি যা চিন্তা করবেন নিজের সম্পর্কে, আপনি তাই। হিপনোটিজম সম্পর্কে দু’একটা কথা বলবো এখন, এই ফাঁকে জেনে নিতে।
পারবেন যা বলেছি তা সত্য কিনা।– আজকাল আমরা হিপনোটিজম সম্পর্কে শত কথা জানতে পারছি। এই বিষয়ে। দীর্ঘকাল যাবৎ যে ভুল ধারণা ছিলো আমাদের মধ্যে, ক্রমশ তার জায়গা দখল করছে সঠিক তথ্য।
‘আমি কক্ষনো সম্মোহিত হবো না।’-সগর্বে এমন দাবি অনেকেই করে থাকে। কি অর্থ দাঁড়ায় এই কথাটার? হয়, সে বলতে চায়, এক, সে নিজেকে। সম্মোহিত হতে অনুমতি দেবে না। কিংবা, দুই, হিপনোটিস্ট তাকে যে জিনিসের উপর গভীর মনোযোগ স্থাপন করার পরামর্শ দেবে তাতে গভীর মনোযোগ স্থাপন করার ক্ষমতা নেই তার।
হিপনোটিস্টদের সংখ্যা কম, এইরকম একটা সাধারণ ধারণা প্রচলিত আছে। আপনি ক’জন হিপনোটিস্টকে চেনেন? বড়জোর একজন কি দু’জনকে চেনেন। বেশিরভাগ লোকের সাথেই কোনো হিপনোটিস্টের পরিচয় নেই। অথচ, কি মজার কথা ভাবুন একবার, আমি আপনি আমরা সবাই আসলে এক একজন হিপনোটিস্ট।
হিপনোটিজম জিনিসটা কি? না-ঘুম না-জাগরণ এমনি একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন। অবস্থা। হিপনোটিস্ট সাজেশন দেয়, সাবজেক্ট অর্থাৎ পাত্র বা পাত্রী সেই সাজেশন গ্রহণ করে, অনুকুল সাড়া দেয় এবং নির্দেশ মত আচরণ করে।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই সাজেশন খয়রাত করে থাকি। যাকে উদ্দেশ্য করে সাজেশন দেয়া তার যদি আমাদের উপর আস্থা এবং বিশ্বাস থাকে, সে নির্ঘাৎ সাজেশন অনুয়ায়ী আচরণ করে-চেতন বা অবচেতন ভাবে।
আত্মসম্মোহন সম্পর্কে মেলা আলোচনা শোনা যায়, কিন্তু আত্মসমোহন সম্পর্কে খুব কম লোকেরই পরিষ্কার ধারণা রয়েছে। অনেকের ধারণা, নিজেকে সম্মোহিত করার জন্যে অসাধারণ একটা মনের অধিকারী হতেই হবে। অথচ, না জেনে, আমরা সবাই, সর্বক্ষণ আত্মসম্মোহনের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি।