আপনাকে জিজ্ঞেস করি, আপনিও কি তাই মনে করেন? অতৃপ্তি খারাপ জিনিস? অতৃপ্ত হওয়া উচিত নয়? যদি বলেন, হ্যাঁ, অতৃপ্তি খারাপ জিনিস বলেই। জানি তাহলে আমি বলবো, আপনি ভুল জানেন।
অতৃপ্তি খারাপ কি ভালো, আমার কাছ থেকে জেনে নিন। আমি আপনাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে চাই, অতৃপ্তি ভালো জিনিস তো বটেই, অতৃপ্তিবোধ আপনার মধ্যে একান্তভাবে থাকা প্রয়োজন।
যে লোক তৃপ্ত, সন্তুষ্ট সে লোক স্থির, দণ্ডায়মান। তৃপ্তিলাভ করা মানে স্থির। হয়ে যাওয়া। তৃপ্ত মানুষ আলসে হয়, তাকে ধাক্কা দিয়েও নাড়ানো সহজ নয়। কেননা তৃপ্ত ২ নুষের চাহিদা থাকে না।
ধরা যাক, আপনি লক্ষ্য নির্দিষ্ট করলেন: বারোশো টাকা বেতনের একটা চাকরি। এই বেতনের একটা চাকরি পেলেই আপনি সন্তুষ্ট, আর কিছু চাইবেন না। চেষ্টা-চরিত্র করে পেলেন বারোশো টাকা বেতনের একটা ভালো চাকরি। তারপর? আর উন্নতি হবে আপনার, আরো বেশি বেতনের চাকরি পাবেন আপনি?
যদি তৃপ্ত থাকেন, চেষ্টাও করবেন না, পাবেনও না। কিন্তু যদি বারোশো টাকা বেতনে অতৃপ্ত থাকেন, পনেরোশো, তারপর দু’হাজার, তারপর আড়াই হাজার এইভাবে আরো বেশি বেতনের চাকরির জন্যে চেষ্টা করবেন আপনি, চেষ্টা করলে পাবেনও।
তৃপ্ত হওয়া আসলে ভালো নয়। মানুষের অতৃপ্তিই স্পৃহা যুগিয়েছে মানবসভ্যতাকে গড়ে তুলতে। যতো বড় বড় আবিষ্কার, মহৎ শিল্পকর্ম, বিস্ময়কর সাফল্য-এই অতৃপ্তির বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে সেসব।
মধ্যযুগে মালামাল বহন করার জন্য গাধা ছিলো, ঘোড়া ছিলো। মানুষ যদি এই ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট থাকতো, ফলাফল কি দাঁড়াতো? আজও কি আমরা, এই যুগের। মানুষরা, গাধা-ঘোড়ার উপর নির্ভরশীল থাকতাম না মাল পরিবহনের জন্যে?
মধ্যযুগের মানুষরা যদি সন্তুষ্ট থাকতো, যান্ত্রিক যানবাহন আবিষ্কৃত হতো না। ধনকুবের ওনাসিসের কথা ধরুন। তিনি যদি নিজের দৈন্য দশায় তপ্ত থাকতেন, পারতেন কি তিনি কোটি কোটি টাকা রোজগার করতে? আপনি যদি আপনার বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকেন, উন্নতি করা, আরো সমৃদ্ধি অর্জন করা কি আপনার দ্বারা সম্ভব? এ কোনো মানুষই সত্যিকার অর্থে তৃপ্ত নয়। কেউ যদি বলে, আমার মধ্যে অতৃপ্তি নেই, আমার যা আছে তাতেই আমি সন্তুষ্ট-তার উদ্দেশে আমি বলবো, সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে ভুল তথ্য জানো তুমি তাই নিজেকে তৃপ্ত বলে মনে করতে বাধ্য করো, নয়তো, তুমি ভীতু বলে নিজেকে অতৃপ্ত জেনেও তা স্বীকার করো না।
সিদ্দিক চৌধুরীর কথা ধরুন। অঙ্কন শিল্প এবং শিল্পী সম্পর্কে এর ভুল ধারণা আছে।
বেশি লেখাপড়া শেখেনি সিদ্দিক চৌধুরী। ঢাকা শহরের একটা বড়সড় রেডিমেড পোশাকের দোকানে সেলসম্যানের চাকরি করে। সুদর্শন, আদব-কায়দা জানে, সাধারণ সেলসম্যানদের চেয়ে তাই ওর বেতন অনেক বেশি। যা পায়, তাতে খেয়েদেয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। চাকরিতে উন্নতি করার চেষ্টা সে বিশেষ করে না, কারণ, ওর লাইনে সর্বোচ্চ বেতন হতে পারে এক হাজার টাকা, পাচ্ছে ও ওই এক হাজার টাকাই প্রতি মাসে।
অথচ, ছবি আঁকার চমৎকার হাত ওর। কারো কাছ থেকে শেখেনি, নিজেই চর্চা করে শিখেছে।
শিল্পী হবার সাধ হয় ওর। কিন্তু শিল্পীদের জীবন সম্পর্কে প্রচলিত এবং প্রায় আজগুবী নানা কিংবদন্তী জানা আছে ওর, সে-সব কিংবদন্তী অজ্ঞ লোকেরা শুনিয়েছে ওকে। শুনে শুনে ওর বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে যে শিল্পী মাত্রই অভাবগ্রস্ত, বাউণ্ডুলে, নীতিহীন, শিল্পীদের জীবন বিড়ম্বনায় পরিপূর্ণ, সুখ, শখ, সাধ ইত্যাদি তারা পূরণ করতে পারে না এবং শেষ বয়সে শিল্পীরা না খেতে পেয়ে রোগে ভুগতে ভুগতে বিনা চিকিৎসায় অসহ্য যন্ত্রণা পেয়ে মারা যায়। শিল্পীরা যে সব ছবি আঁকে তা ভুলেও কখনো কেউ কেনে না, এই মিথ্যে ধারণাও রয়েছে ওর মধ্যে।
শিল্পীদের জীবন আতঙ্ককর বলে মনে করে সিদ্দিক চৌধুরী, তাই শিল্পী হতে রাজি নয় সে, বর্তমান অবস্থায় অগত্যা সে নিজেকে তৃপ্ত থাকতে বাধ্য করছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভুল ধারণা রয়েছে বলেই সিদ্দিক চৌধুরী তার অতৃপ্তিবোধটাকে দমন করে রেখেছে, নিজেকে বিকশিত হতে দিচ্ছে না।
আর একটা কারণ, ভয়।
অনেকে অনেক কিছু হতে চায়, কিন্তু ভয় তাদেরকে এগোতে দেয় না। আমি একজন লোককে চিনি যে ছোটো খাটো একটা ব্যবসা করে কিন্তু ব্যবসাটা তেমন চালু নয় বলে সংসারে সচ্ছলতা আসছে না। বিদেশ থেকে আমদানী করা কাঁচামাল কালোবাজার থেকে কিনে কারখানায় তৈরি করে সে নানা ধরনের পাউডার, স্নো, ক্রিম, লিপস্টিক। খরচ অনেক বেশি পড়ে বলে লাভ যা হয় তাতে পোষায় না। লোকটার ব্যাপারে জানতে পেরে তাকে আমি পরামর্শ দিলাম, কালোবাজার থেকে কাঁচামাল না কিনে বিদেশ থেকে আমদানী করুন, সরকারের কাছে আবেদন করুন। লাইসেন্স পাবার জন্যে। ১৯ বছর তিনেক পর আবার দেখা লোকটির সাথে। ব্যবসার অবস্থা জানতে চাইলে সে যা বললো তার সারমর্ম হলো: আগের অবস্থাতেই স্থির হয়ে আছে ব্যবসা। লাইসেন্স পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে বললো, কন্ট্রোলার অফ ইমপোর্ট-এর অফিসে একদিন গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখি সুটেড-বুটেড দামী কাপড় চোপড় পরা শিক্ষিত ধনী রুইকাতলারা ছুটোছুটি করছে, ফটাফট কথা বলছে ইংরেজিতে। দেখেশুনে ভয়ই পেলাম। লাইসেন্সের জন্যে আবেদন যে করবো, ইংরেজি লিখতেই তো পারি না। দরকার নেই লাইসেন্স পেয়ে, লাইসেন্স পাবার যোগ্যতা আমার নেই! হীনম্মন্যতার শিকার এই লোক, যার ফলে নিজেকে খারাপ