নতুন, ঝকঝকে, হাল ফ্যাশনের একটা প্রাইভেট কার পেলে খুব মজা হতো, না? চান একটা ওইরকম গাড়ি? ঠিক আছে। বলে দিচ্ছি কি করতে হবে। দেরি না। করে গাড়ির ডিলার বা এজেন্টদের শো-রূমে যান একবার। আজ গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়। সেখানে অনেকরকম গাড়ি দেখবেন, কিন্তু পছন্দ করবেন যেটা চান সেটা। পছন্দ করার পর থেকে ভাবতে শুরু করুন, ওই বিশেষ কোম্পানির বিশেষ গাড়িটি আপনারই। মনে মনে কল্পনা করুন, দেখবেন ভালো লাগবে, গাড়িটা নিয়ে বন্ধু-বান্ধব বা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সমেত বেড়াতে যাচ্ছেন রাঙ্গামাটি বা কক্সবাজার। ও হ্যাঁ, একটা ছবি সংগ্রহ করতে হবে গাড়িটিরও।
ফার্নিচার, কাপড়, স্বর্ণ এবং অন্যান্য দোকানে যান, জিনিসপত্র পছন্দ করুন। ঘুরে ঘুরে। এতোদিন যে-সব জিনিসের স্বপ্ন দেখেছেন সেই সব জিনিস দোকানে। দোকানে ঢুকে চাক্ষুষ করুন, প্রত্যক্ষ করুন, মনের পর্দায় গেঁথে ফেলুন প্রত্যেকটি জিনিসের ছবি-এবং ভাবুন এসব জিনিস আপনার আয়ত্তে না আসার কোনো কারণ নেই, এসব জিনিস আপনারই জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে, এগুলো আপনারই।
কাম্যবস্তু অর্জন করা কি কি কারণে সম্ভব নয় তা ভাবতে যাবেন না। অধিকাংশ মানুষ সর্বদা অজুহাত দেখায় এই–এই কারণে সে সাফল্য লাভ করতে পারবে না। তারা কক্ষনো সফল হবার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। অর্থাৎ পরিকল্পনায় হাত দেবার আগেই পরিকল্পনাটাকে ব্যর্থ বলে মেনে নেয়। তারা। তাদের দ্বারা সাফল্য আশা করা বৃথা। কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা যদি ব্যর্থ প্রমাণ হয়ই, সেক্ষেত্রে নতুন পরিকল্পনা করা দরকার। বিকল্প পদ্ধতি থাকেই, গ্রহণ করলেই হয়। ব্যর্থতাকে মেনে নেয়া মানে নিজের কাছে অপরাধ করা।
আপনি অভিযোগ তুলে বলতে পারেন, যে জিনিস এখনো আমি পাইনি সে জিনিস পেয়েছি বলে মনে করে আনন্দে মাতোয়ারা হবে কেন? এ তো গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতো ব্যাপার। ব্যাপারটা আসলে তাই-ই, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতোই। তেল দিন গোঁফে, গাছের কাঁঠালটা আপনার জন্যেই নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে। ওটা আপনারই। গোঁফে তেল না দিলে কাঁঠাল পাবার আশা নেই আপনার।
আমার স্নেহভাজন শেখর চৌধুরী, (বলা বাহুল্যঃ ছদ্মনাম) পেশাদার লেখক, বহু বছরের সম্পর্ক তার সাথে, ব্যক্তিগত আলোচনা প্রসঙ্গে প্রায়ই সে নৈরাশ্যব্যঞ্জক সংলাপ উচ্চারণ করতো। শুধু লেখা বিক্রি করে সংসার ধর্ম পালন করছে ও। এটা একটা কঠিন, প্রায়-অসম্ভব কাজ এদেশে। গড়পড়তা মাসিক যা আয় তাতে দিন চলে যাচ্ছে, কিন্তু অভাব রয়েছে আর্থিক নিরাপত্তাবোধের, সঞ্চয়ের কোঠা শূন্য থাকছে, বীমা করার সঙ্গতি নেই-ইত্যাদি। অর্থাৎ স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষদের। যা যা সমস্যা, ওরও সেই সমস্যা। ওটা আসলে খুবই ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতি। ও বা ওর পরিবারের কেউ যদি কঠিন কোনো রোগে পড়ে, চোখে অন্ধকার দেখবে গোটা পরিবারটা। তার উপর রয়েছে একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যে। প্রয়োজনীয় বিলাস দ্রব্যের অভাব, এবং সেইহেতু বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভের কারণে ও লেখার কাজে ততোটা আন্তরিক হতে পারছে না যতোটা হওয়া উচিত, পরিবারের প্রতি ততোটা দায়িত্বশীল হতে পারছে না যতোটা হওয়া উচিত, সমাজ এবং সভ্যতার জন্যে অবদান রাখতে পারছে না ক্ষমতানুযায়ী যতোটুকু রাখা উচিত।
ওর সমস্যাটা নিয়ে একদিন আলোচনা করলাম আমরা। দেখলাম, ওর ভয়ঙ্কর অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে ওর। আরো আবিষ্কার করলাম, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবার উপায় কি তাও জানে ও। তার মানে, ‘আমি পারি’ এই সচেতনতা আছে ওর। নেইটা তাহলে কি?
‘আমি করবো’-এই সংকল্পের অভাব। দেখিয়ে দিলাম ওর ত্রুটিটা। আলোচনার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলাম, কিভাবে এই ত্রুটি সংশোধন করা যায়।
স্থির হলো, অতিরিক্ত আয়ের একটা উপায় বের করতে হবে। অতিরিক্ত আয়-কি ভাবে সম্ভব? আরো বেশি লিখলে কি আরো বেশি টাকা আসবে? এমনিতেই ও যথেষ্ট বেশি লিখতে পারে, যা লেখে তা-ই ছাপার জন্যে পাবলিশার পাওয়া যায় না। তাছাড়া আরো বেশি লিখলে লেখার মান খাটো হয়ে যাবে। শুধু লেখা কেন, অনুন্নত মানের কোনো কিছুই বাজারে বিকায় না।
তাহলে?
ব্যবসা করার পরামর্শ দিলাম ওকে। সাথে সাথে কয়েকটা সমস্যা মাথা তুলে দাঁড়ালো, সামনে এগোতে দেবে না। ব্যবসা মানেই পুঁজি। পুঁজি তো নেই। উপায়?
উপায় বের করার আগে ওকে স্থির করতে বললাম, কি ব্যবসা করতে চায়।
ও বললো, বইয়ের ব্যবসাটাই ওর কাছে ওর রুচি অনুযায়ী ভদ্র ব্যবসা। ছোটোখাটো একটা বইয়ের দোকান করতে পুঁজিও লাগবে কম। পরিচিত পাবলিশারদের কাছ থেকে ধারে বই তুলতে পারবে দোকানে। দোকানে বসে লেখার কাজও চালাতে পারবে।
আলোচনা এইটুকুই। ও, হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি, আলোচনা শেষে সেলফ ইমপ্রুভমেন্ট সম্পর্কিত কয়েকটি বই দিলাম ওকে পড়তে।
মাত্র পনেরোদিন পর ও এলো। বললো, দোকান পেয়েছি। কিছু টাকা দিন। জিজ্ঞেস করলাম কতো? বললো, দুশো দিলেই চলবে। অবাক কাণ্ড, দুশো টাকায় দোকান হয় কিভাবে? প্রশ্ন করতে বললো, দোকানের জন্যে অ্যাডভান্স দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। বেনু সুইট ল্যাণ্ডের ‘আই উইল’ বইটির পরামর্শ অনুযায়ী বন্ধু, আত্মীয় এবং শুভানুধ্যায়ীদের একটা তালিকা তৈরি করেছে ও। একজনের উপর চাপ সৃষ্টি না করে, টাকা ধার চাইবে ও মোট ত্রিশ জনের কাছে। দুশো করে চাইবে, সকলের কাছ থেকে পেলে হবে ছয় হাজার টাকা। দোকান নেয়া হয় তাহলে।