তখন বঙ্গবাসী সঞ্জীবনী কাগজ বের হত। ঈশ্বরবাবু বঙ্গবাসী দেখতে পারতেন না; বলতেন, বঙ্গবাসী আবার একটা কাগজ, ইংলিশম্যান পড়ো। ইংলিশম্যান কাগজ দ্বারকানাথের আমলের, আগের নাম ছিল হরকরা, তিনিই বের করে গেছেন।
তখন সেই বঙ্গবাসীতে শশধর তর্কচূড়ামণি, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ ও চন্দ্রনাথ বসু এই তিনজন লোক রবিকাকার কবিতা গল্প নিয়ে খুব লেখালেখি করতেন, তক্কাতক্কি হত। তখনকার কাগজগুলিই ছিল ঐ-রকম সব খোঁচাখুঁচিতে ভরা। রবিকাকা ওঁরা তখন একটা কাগজ বের করেন যাতে কোনোরকম গালাগালি ঝগড়াঝাঁটি থাকবে না। থাকবে শুধু ভালো কথা, কাগজের নাম বড়োজ্যাঠামশায় দিলেন ‘হিতবাদী’। সেই সময়েই ‘সাধনা’য় বের হল রবিকাকার ‘হিং টিং ছট’ নামে কবিতাটি।
আমরা ঈশ্বরবাবুকে গিয়ে বললুম, দেখে তো এই কবিতাটি কেমন হয়েছে, একবার পড়ে দেখো, একে কবিতা বলে কি না। এই বলে আমরাই তাকে কবিতাটি পড়ে শোনাই। সেই কবিতাটি শুনে ঈশ্বরবাবু ভারি খুশি; বললেন, এটা লিখেছে ভালো হে, এতদিনে হয়েছে ছোকরার, হ্যা একেই বলে লেখা।
এইবার ঈশ্বরবাবুও পথে এলেন।
তা রবিকাকার লেখা দেশের লোক অনেকেই অনেককাল অবধি বুঝত না, উল্টে গালাগালি দিয়েছে। সেদিনও যখন আমি অসুখের পর স্টীমার বেড়াই, তখন তো আমি বেশ বড়োই, এক ভদ্রলোক বললেন, রবিবাবু যে কী লেখেন কিছু বোঝেন মশায়? রবিকাকা বিলেত থেকে আসার পর দেখি তেমন আর কেউ উচ্চবাচ্য করে না। হয় কী, বড়ো একটা গাছের উপর হিংসে, সেটা হয়। বন্ধুভাগ্য যেমন ওঁর বেশি, অবন্ধুও কম নয়।
তা, সেই খামখেয়ালীর সময় দেখেছি, কী প্রোডাকশন ওঁর লেখার, আর কী প্রচণ্ড শক্তি। নদীর যেমন নানা দিকে ধারা চলে যায়, তাঁর ছিল তেমনি। আমাদের মতো একটা জিনিস নিয়ে, ছবি হচ্ছে তো ছবি নিয়েই বসে থাকেন নি। একসঙ্গে সব ধারা চলত। কংগ্রেস হচ্ছে, গানবাজনা চলেছে, নাচও দেখছেন, সামান্য আমোদ-আহ্লাদ-আনন্দও আছে, আর্টেরও চর্চা করতেন তখন। ঐ সময়ে আমাকে মাইকেল এঞ্জেলোর জীবনী ও রবিবর্মার ফোটোগ্রাফের অ্যালবাম দিয়েছিলেন।
খেয়াল গেল ছোটোদের স্কুল করতে হবে। নীচের তলায় ক্লাস-ঘর সাজানো হল বেঞ্চি দিয়ে, ঝগড়ু চাকর ঝাড়পোঁছ করছে, ঘণ্টা জোগাড় হল, ক্লাস বসবে। কোত্থেকে মাস্টার ধরে আনলেন। কোথায় কী পাওয়া যাবে, রবিকাকা জানতেনও সব। হাল্কাভাবে কিছু হবার জে৷ নেই, যেটি ধরছেন, নিখুঁতভাবে সুসম্পন্ন করা চাই। ছেলেদের উপযোগী বই লিখলেন, আমাকে দিয়েও লেখালেন। ঐ সময়েই ‘ক্ষীরের পুতুল’ ‘শকুন্তলা’ ঐ-সব বইগুলি লিখি। নানা জায়গা থেকে বাল্যগ্রন্থ আনালেন।
প্রকাণ্ড ইন্টেলেক্ট, অমন আমি দেখি নি আর। বটগাছ যেমন নানা ডালপালা ফুলফল নিয়ে আপনাকে প্রকাশ করে রবিকাকাও তেমনি বিচিত্র দিকে ফুটে উঠলেন। যেটা ধরছেন, এমন-কি ছোটোখাটো গল্প, তাতেও কথা কইবার জো নেই, সব-কিছু এক-একটি সম্পদ। লোকে বলে এক্সপিরিয়েন্স নেই, কল্পনা থেকে লিখে গেছেন, তা একেবারেই নয়। লোকে খামখেয়ালীর যুগে থাকলে বুঝতে পারত।
মাথায় এল ন্যাশনাল কলেজ কী করে করা যাবে। তারক পালিত দিলেন লক্ষ টাকা, স্বদেশী যুগের টাকাও ছিল কিছু, তাই দিয়ে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্স্টিটিউট নামে কলেজ খোলা হল। তাতে তাঁত চলবে, দেশলাইয়ের কারখানা আরো সব-কিছু থাকবে।
কলেজ চলছে, মাঝে মাঝে কমিটির মিটিং বসে।
এখন, এক কমিটি বসল বউবাজারের ওখানে একটি বাড়িতে। রবিকাকা গেছেন, আমরাও গেছি, ভোট দিতে হবে তো মিটিঙে। সার্ গুরুদাস বাঁড়ুজ্জে সভার প্রেসিডেন্ট, ইচ্ছে করেই ওঁকে করা হয়েছে, তা হলে ঝগড়াঝাঁটি হবে না নিজেদের মধ্যে। কোনো প্রস্তাব হলে উনি দু-পক্ষকেই ঠাণ্ডা রাখছেন। রবিকাকা সেই মিটিঙে প্রস্তাব করলেন এমন করে কলেজের কাজ চলবে না। প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিঙের দরকার। ছ-সাতটি ছেলেকে খরচ দিয়ে বিদেশে জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে সব শিখিয়ে তৈরি করে আনা হোক।
খুবই ভালো প্রস্তাব। প্র্যাকটিক্যাল ট্রেলিঙের খুবই প্রয়োজন, নয় তো চলছে না। সে মিটিঙে আর-এক জন পাল্টা প্রস্তাব করলেন, তিনি এখন নামজাদা প্রফেসার, ‘তার দরকার কী মশায়। বই আনান, বই পড়ে ঠিক করে নেব।’
শেষে সেই প্রস্তাবই রইল। আমরা সব অবাক। রবিকাকা চুপ। এই রকম সব ব্যাপার ছিল তখন। রবিকাকার স্কীমের ঐ দশা হত। বাধা পেয়েছেন অনেক, অন্যায় ভাবে। সেই সময় থেকেই বোধ হয় ওঁর মনে মনে ছিল যে নিজেদের একটা-কিছু না করলে হবে না। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য আশ্রমে রবিকাকা নিজের মনের মতো ফ্রি স্কোপ পেলেন। জমিজমা পুরীর বাড়ি এমন-কি কাকীমার গায়ের গয়না বিক্রি করে শান্তিনিকেতনে সব ঢেলে দিয়ে কাজ শুরু করলেন।
১৩. বিরজিতলায় মেজোজ্যাঠামশায়ের বাড়িতে
বিরজিতলায় মেজোজ্যাঠামশায়ের বাড়িতে ‘মায়ার খেলা’ অভিনয় হয়। ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’র পরে এই ‘মায়ার খেলা’, যা দেখে মন নাড়া দিয়েছিল।
‘রাজা’ অভিনয় প্রথম বোধ হয় এই বাড়ির উঠোনেই হয়। আমরা তাতে কী সেজেছিলুম মনে পড়ছে না। স্টেজ ডেকোরেশন আমরাই করেছি।
একবার ‘শারদোৎসবে’ প্রম্প্টারকে স্টেজে নামিয়েছিলুম, তা জানো না বুঝি? এক অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছিল। রবিকাকা আমরা সবাই আছি। দেখি থেকে থেকে আমরা পার্ট্ ভুলে যাচ্ছি। ভয় হয় রবিকাকা কখন ধমকে টমকে বসবেন। রবিকাকাও দেখি মাঝে মাঝে আটকে যান। পার্ট আর মুখস্থ হয় না।