তখন মাসটা কী মনে পড়ছে না, খুব সম্ভব বৈশাখ। আমের সময়। বসে আছি বাগানে। খুব আম-টাম খাওয়া হল। রীতিমত পেটের সেবা করে তার পর গান। জ্যোতিকাকামশায় বললেন, ‘রবি, গান গাও।’ গান হলেই রবির গান হবে। আমি তখন সাত-আট বছরের ছেলে। রবিকাকার দশ বছরের ছোটো। ওঁর তখন সতেরো বছর। সেই গানটা হল—
ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।
গঙ্গার ধারে, জ্যোতিকাকামশায় হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন, প্রথম সেই গান শুনলুম, সে-সুর এখনো কানে লেগে রয়েছে। কী চমৎকার লাগল। গান হতে হতে সন্ধে হল, মেঘ উঠল। গঙ্গার উপর কোন্নগরী মেঘ। নতুনকাকীমা বললেন, ‘আর না, এবারে ছেলেদের নিয়ে রওনা দাও।’
ঘোড়ার গাড়িতে আসতে আসতে কী ঝড়, কী বৃষ্টি। ‘চেরেট’ গাড়ি, নতুন রকমের। আমরা কটি ছেলে, বাবামশায় আর বড়োপিসেমশায়! গাড়িটা ছিল কতকটা টঙ্গা গোছের। গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে মড়মড় করে একটা ডাল ভেঙে পড়ল গাড়ির সামনে। ওটা গাড়ির উপর পড়লে রবিকাকার গান শোনা সেই প্রথম এবং শেষ হত আর আমারও গল্প বলা ঐখানেই থেমে যেত। বাল্যকালে যখন সুরবোধ হয় নি, তখন সেই গান শুনে ভালো লেগেছিল। ‘ভরা বাদর’ গাইবার সঙ্গে সঙ্গে সুরের বর্ষার সঙ্গে সত্যিকার বর্ষা নামল।
সেদিন আর ফিরবে না। তার পর গানের পর গান শুনেছি, সেই প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত ওঁর কত গানই শুনেছি। যৌবনের পাখি চলে গেছে, আর-এক পাখি এসেছে। তিনি লিখেছেন—আমি চলে যাব, নতুন পাখি আসবে। কিন্তু নতুন পাখি আর আসবে না! একলা মানুষের কণ্ঠে হাজার পাখির গান। আমার এখনো মনে হয় তার সব রচনার মধ্যে—লেখাই বলে, ছবিই বলো—সব চেয়ে বড়ো হচ্ছে তাঁর গানের দান।
কথার সঙ্গে সুর রবিকাকার মতো কেউ মেলাতে পারে নি। ব্রহ্মসংগীতের সবগুলো সুর ওঁর নিজস্ব সুর নয়। ‘মায়ার খেলা’র মতো অপেরা আর হয় নি। আমি সেদিন রথীকে বলেছিলুম, ‘মায়ার খেলা কর-না আর-একবার।’ রথী বললে, ‘লোকে বলে ওতে কেবলই ‘লভ’।’ আমি বললুম, ‘ও-রকম লোক তোমাদের দলে যদি কেউ থাকে তাকে বিদেয় করে দিয়ো।’ ‘মায়ার খেলা’য় তিনি প্রথম সুরকে পেলেন, কথাকেও পেলেন! বোধ হয় ‘সখিসমিতি’র সাহায্যার্থে ওটি রচিত হয়, ওতে তাঁর নিজের কথার সঙ্গে সুরের পরিণয় অদ্ভুত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওখানে একেবারে ওঁর নিজস্ব সুর। অপেরা-জগতে ওটি একটি অমূল্য জিনিস। কিন্তু হায়, যে ও-সব গান গাইবে সে মরে গেছে। সেই পাখির মতো আমাদের ছোটো বোনটি চলে গেছে। এখনো ‘মায়ার খেলা’র গান যদি কাউকে গাইতে শুনি, তার গলা ছাপিয়ে কতদূর থেকে আমাদের সেই বোনটির গান যেন শুনি।
সে-সুরে যে পাখি গাইত সে পাখি মরে গেছে। কে গাইবে। অভির গলায় ঐ সুর যা বসেছিল! তার গলার timbre অদ্ভুত ছিল। প্রতিভাদিদিও গেয়েছেন, কিন্তু ও-রকম নয়। গান শুনে তবে মায়ার খেলা বুঝতে হয়।
ওঁর গান শুনলে এখনো আমার মনে যে কী ভাবের উদয় হয় তা ওঁরই একটি গানের একটি ছত্রে বলছি:
পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে।
১২. সেই খামখেয়ালীর যুগে রবিকাকাকে দেখেছি
সেই খামখেয়ালীর যুগে রবিকাকাকে দেখেছি, তাঁর তখন কবিত্বের ঐশ্বর্য ফুটে বের হচ্ছে। চার দিকে নাম ছড়িয়ে পড়ছে। বাড়িতেও ছিলেন তিনি সবার আদরের। বাবামশায় যখন সভায় মজলিসে ‘রবির একটা গান হোক’ বলতেন সে যে কী স্নেহের সুর ঝরে পড়ত। তখন রবিকাকার গাইবার গলা কী ছিল, চার দিক গমগম করত। বাড়িতে কিছু একটা হলেই তখন ‘রবির গান’ নইলে চলত না। আমরা ছিলুম সব রবিকাকার অ্যাডমায়ারার। জ্যোৎস্নারাতে ছাদে বসে রবিকাকার গান হত। সে-সব দিন গেছে। কিন্তু ছবি চোখের উপর ভাসে, স্পষ্ট দেখতে পাই, এখনো সে-সব গানের সুর কানে লেগে আছে যেন। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি বাবামশায়ের আমলে বাড়িতে তখন ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’ বলে একটা সভা বসত। তাতে জ্ঞানীগুণীরা আসতেন, সভার নাম দেখেই বুঝতে পারছ। প্রতিভাদিদির ওস্তাদী গান হত। আমরা ফুল লতা দিয়ে দোতালার হল্-ঘর সাজাতুম। সেইখানেই সভা হত। বাবামশায় তখন আমাদের উপর ঐ-সব ছোটােখাটাে কাজের ভার দিতেন। সভার নাম আমাদের মুখে ভালো করে আসত না, আমরা নাম দিয়েছিলুম ‘বিদ্যুতজন সমাগম’ সভা। রঘুনন্দন ঠাকুর একবার প্রতিভাদিদিকে তানপুরো বকশিশ দিয়েছিলেন।
এখনো মনে আছে সভায় বাবা বলতেন, জ্যোতি, তুমি তোমার হারমোনিয়াম বাজাও, রবি, তোমার সেই গানটা করো—‘বলি ও আমার গোলাপবালা’। ঐ গানটি তখন সবার খুব পছন্দ ছিল। থেকে থেকে হুকুম হত, ‘গোলাপবালা’র গানটা হোক।
কিন্তু বক্তা ঈশ্বরবাবু, তিনি একেবারে রবিকাকার উল্টো। তিনি বলতেন, কী কবিতা লেখে রবিবাবু, চল, চল, বল, বল, ও কি কবিতা। আর একে কী গান বলে, ‘বলি ও আমার গোলাপবালা’। হ্যাঁ, গলা হচ্ছে সোমবাবুর, যেমনি গলা তেমনি গান গায় বটে। রবিবাবু আবার কী গান গায়।
ঈশ্বরবাবুকে আর আমরা বাগ মানাতে পারি নে। নুড়ো গোপাল মস্ত ওস্তাদ, তিনিও শেষটায় স্বীকার করেছিলেন রবিকাকার গানে কিছু আছে। কিন্তু ঈশ্বরবাবুকে আর পেরে উঠছি না। তখন আমরা ছিলুম রবিকাকার গানের কবিতার পরম ভক্ত; কেউ কিছু সমালোচনা করলে কোমর বেঁধে লাগতুম, তাদের বুঝিয়ে ঘাড় কাত করিয়ে তবে ছাড়তুম।