কালী কালী বলে রে আজ—
বলো হো, হো হো, বলো হো, হো হো,
বলো হো।
নামের জোরে সাধিব কাজ…
হাহাহা হাহাহা হাহাহা!
সবাই মিলে চেঁচিয়ে গান ধরেছি আর সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটে অর্গান প্রাণপণে টিপে বাজানো হচ্ছে, আর ঐ উদ্দাম নৃত্য—খোলা আসল তলোয়ার ঘুরিয়ে। কারো যে নাক কেটে যায় নি কী ভাগ্যিস। কী হাততালি পড়তে লাগল, এন্কোর এন্কোর চার দিক থেকে। কিন্তু ঐ জিনিস কি আর দুবার হয়।
হাতবাঁধা বালিকাকে আনা হল, অভি গান গাইলে,
হা, কী দশা হল আমার!
কোথা গো মা করুণাময়ী,
অরণ্যে প্রাণ যায় গো।
মুহূর্তের তরে মা গো, দেখা দাও আমারে—
জনমের মতো বিদায়।
সাহেবরা এ-সব তত বোঝে না, বাঙালি যাঁরা ছিলেন কেঁদে ভাসিয়ে দিলেন।
বাল্মীকি স্টেজে ঢুকে শাঁখ ফুঁকে ডাকাতদের ডাকবেন। স্টেজে ঢুকে শাঁখ ফুঁকতে যাচ্ছেন, চোখে সোনার চশমা চকচক করছে। আমি বলি, ও রবিকাকা, চশমা, তোমার চোখে চশমা রয়েছে যে। রবিকাকা তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে চশমা খুলে নিলেন।
ক্ৰৌঞ্চমিথুন শিকার করব, এবারে আর তুলোর বক এনে বসানে হয় নি। বুদ্ধি খুলেছে, ক্ৰৌঞ্চমিথুন দেখানোই হল না, অদৃশ্যে রয়ে গেল। সঙ্গীদের ডেকে ডেকে বলছি,
দেখ্, দেখ্, দুটো পাখি বসেছে গাছে।
আর দেখি চুপি চুপি আয় রে কাছে।
সে একেবারে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে এগচ্ছি, বোঝো তো স্টেজে ঐটুকু হাঁটতে ক-সেকেণ্ডেরই বা কথা কিন্তু মনে হত যেন সময় আর কাটে না। ধনুকে তীর লাগিয়ে টানাটানি করতে করতে যেই বলা
আরে, ঝট্ করে এইবারে ছেড়ে দে রে বাণ,
সঙ্গে সঙ্গে সবায়ের তীর ছোঁড়া—অডিয়েন্সের মধ্যে কী খুশির ঢেউ। সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। পাঁকাটির তীর নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ল, খালি ক্রৌঞ্চমিথুনই বধ হল না। আর আমাদের সে কী গান,
এই বেলা সবে মিলে চলো হো, চলো হে,…
বাজা শিঙা ঘন ঘন, শব্দে কাঁপিবে বন।
বন তো কাঁপত না, আমাদের গানের চীৎকারে পাড়াসুদ্ধ লোক জমাট বাঁধত দরজার সামনে, ভাবত হল কী এদের।
আকাশ ফেটে যাবে, চমকিবে পশুপাখি সবে,
কিন্তু পাখি তখন কোথায়, আমাদের গানের এক-এক হুংকারে সাহেবদের টাক চমকে উঠত। আমরা ‘হো হো হো হো’ শব্দে মেতে উঠতুম।
অক্ষয়বাবুর তো ঐ ভুঁড়ি, তার উপর আরো গোটা দুই বালিশ পেটের উপর চাপিয়ে ফেটি জড়িয়ে ইয়া ভুঁড়ি বাগালেন। আমরা গান করতুম,
বনবাদাড় সব ঘেঁটেঘুঁটে
আমরা মরি খেটেখুটে,
তুমি কেবল লুটেপুটে
পেট পোরাবে ঠেসেঠুসে!
বলে খুব আচ্ছা করে সবাই মিলে চার দিক থেকে অক্ষয়বাবুর ভুঁড়িতে ঘুষি মারতুম। অক্ষয়বাবুও থেকে থেকে ভুঁড়িটা বাড়িয়ে দিতেন। সে যা ব্যাপার।
বাল্মীকি দল ছেড়ে চলে গেছে, ডাকাত-সর্দার অক্ষয়বাবু গান ধরলেন,
রাজা মহারাজা কে জানে,
আমিই রাজাধিরাজ।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি উজির’, আর-একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোতোয়াল তুমি’, আর অডিয়েন্সের সাহেব-সুবোদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ ছোঁড়াগুলো বর্কন্দাজ’, বলে স্টেজে এক ঘূর্ণিপাক। আমি ভাবছি, করেন কী অক্ষয়বাবু। ভাগ্যিস সাহেবরা বাংলা জানে না; তাই তারা অক্ষয়বাবুর গানের প্রতি লাইনে হাততালি দিয়ে যাচ্ছে।
দস্যু সর্দার বসলেন রাজাধিরাজ হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে, আমাদের দিকে হাত নেড়ে পা দেখিয়ে বললেন,
পা ধোবার জল নিয়ে আয় ঝট্,
কর্ তোরা সব যে যার কাজ।
বললেন সুর করে,
জানিস না কেটা আমি!
আমরা বললুম,
ঢের ঢের জানি—ঢের ঢের জানি—
ভারি ফুর্তি আমাদের, দস্যু-সর্দারকে মানছি নে, উলটে আরো বকছি,
খুব তোমার লম্বাচওড়া কথা।
নিতান্ত দেখি তোমায় কৃতান্ত ডেকেছে।
সে যা অভিনয়; আমন আর হয় নি, কখনো হবেও না। ডাকাতের দল সেবারে স্টেজ মাৎ করে দিয়েছিল, স্টেজে ডাকাত ঢুকলেই হল একবার, চারি দিক থেকে অডিয়েন্স উৎসাহে হাততালি দিয়ে, এন্কোর বলে, সে এক কাণ্ড।
অক্ষয়বাবু সেবার যা ডাকাত সেজেছিলেন, লাটসাহেবের মেম তাঁর খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, এ-রকম অ্যাক্টার যদি আমাদের দেশে যায় তবে খুব নাম করতে পারে। অক্ষয়বাবুর কী দেমাক, একেবারে বুক দশ হাত ফুলে উঠল। প্রায়ই আমাদের বলতেন, লেডি ল্যান্সডাউন আমার কথা বলেছেন যে He is my man জানো তা, এ কি চালাকি নাকি।
তার উপর রবিকাকার গান, আর তাঁর তখনকার গলা, যখন গাইতেন,
এ কী এ, এ কী এ, স্থির চপলা!
কিরণে কিরণে হল সব দিক উজলা।
সব লোক একেবারে স্তব্ধ হয়ে যেত।
লক্ষ্মী সেজে বিবি যখন লাল আলোতে স্টেজে ঢুকত, আহা সে যে কী সুন্দর দেখাত। সরস্বতীর বেলায় থাকত সব সাদা—সাদা শোলার পদ্মফুলের মধ্যে শুভ্র সাজে প্রতিভাদিদি যখন বীণা হাতে বসে থাকতেন প্রথমে সবাই ভেবেছিল মাটির প্রতিমা। সেও যে কী শোভা কী বলব তোমাকে। অষ্ট্রীচের ডিমের খোলা দিয়ে শখ করে একটি ছোটো সেতার বানিয়েছিলুম, সেটা রুপোলি রাংতা দিয়ে মুড়ে বীণা তৈরি হয়েছিল। আমার সেই সেতারটি ঐ করে করেই গেল। তা সেই বীণাটি হাতে নিয়ে প্রতিভাদিদি বসে থাকতেন, শেষটায় উঠে রবিকাকার হাতে বীণা দিয়ে বলতেন,
এই নে আমার বীণা, দিজু তোরে উপহার—
যে গান গাহিতে সাধ, ধ্বনিবে ইহার তার।
সে কথা সত্যি সত্যিই ফলল ওঁর জীবনে।
১১. ভগ্নহৃদয় লেখা চুকিয়ে রবিকাকা
ভগ্নহৃদয়’ লেখা চুকিয়ে রবিকাকা সেই সবে বিলেত থেকে ফিরেছেন। জ্যোতিকাকামশায় থাকেন তখন ফরাশডাঙার বাগানে। আমরা থাকি চাঁপদানির বাগানে। এই দুই বাগান আমাদের দুই পরিবারের। আমরা তখন ছোটো ছোটো ছেলে। এক-একদিন বেড়াতে যেতুম ফরাশডাঙার বাগানে যেমন ছেলেরা যায় বুড়োদের সঙ্গে। সেই একদিনের কথা বলছি।