তখন এ-রকম ইলেকট্রিক বাতি ছিল না, গ্যাস বাতি, কার্বন লাইটের ব্যবস্থা হল। লাল সবুজ মখমলের পর্দা দিয়ে স্টেজ সাজানো হল। এটা সেটা কিছুই বাদ নেই। কর্তাদাদামশায়ের খরচ—মনের সুখে জিনিসপত্তর আনিয়ে সাজানো গোছানো গেছে।
ও দিকে আবার বিরাট পার্টি। লাটসাহেবের মেম, দেদার সাহেব-সুবো ও বড়ো বড়ো মান্যগণ্য লোক সবাইকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। নীচে স্টেজ, উপরে দোতলার ছাদে ‘সাপার’ হবে, কত রকমের খাবারের আয়োজন, বরফের পাহাড় হয়ে গেছে। মেজোজ্যাঠামশায়, জ্যোতিকাকা, সারদা পিসেমশায় তারা সব রইলেন অতিথিদের খাওয়া দেখাশোনার ভার নিয়ে, রবিকাকা রইলেন আমাদের নিয়ে।
অভিনয়ের দিন এল; সব-কিছু তৈরি, নিতুদা স্টেজ ম্যানেজার, অামাদের সাজসজ্জা তৈরি, কাবুলী ইজের পরা, কোথায়ও না গা দেখা যায়, একেবারে নতুন সাজ। লম্বা জোব্বা-টোব্বা পরে রবিকাকাও তৈরি, গলায় চেনে বাঁধা৷ শঙ্খ ঝুলছে, শৃঙ্গবাদন করে ডাকাত ডাকবেন, সব ঠিকঠাক। অতিথিঅভ্যাগতরাও এসেছেন সৰ। অভিনয় শুরু করবার সময় হল। আমাদের যে বুক একটু দুরদুর না করেছে এমন নয়। রবিকাকাও যেমন একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েন এ-সব ব্যাপারে, অামাকে বললেন, দেখো তো কেমন লোকজন হয়েছে বাইরে।
আমি তো কাঁচুমাচু করছি, কী দরকার দেখবার, হয়তে ঘাবড়ে যাব।
রবিকাকা বলছেন, আঃ, দেখোই না পর্দাটা একটু ফাঁক করে, কী রকম লোকজনের ভিড় হয়েছে দেখো।
স্টেজের ভিতর থেকেই এ-সব কথা হচ্ছে আমাদের। আমি আর কী করি, পর্দাটা আস্তে আস্তে একটু ফাঁক করে দেখি কী, ওরে বাবা! টাকে টাকে সারা উঠোন ভরে গেছে যে। যত-সব সাহেবদের সাদা সাদা মাথা একেবারে চকচক করছে। বুক দুরুদুরু করতে লাগল। আমি বললুম, এ না দেখলেই ভালো হত রবিকাকা। রবিকাকাও বললেন, তাই তো।
এ দিকে সময় হয়ে গেছে, আশু চৌধুরী উইংসের এক পাশে প্রোগ্রাম হাতে দাঁড়িয়ে, পিয়ানো হারমোনিয়াম নিয়ে জ্যোতিকাকামশায়, বিবি বসে, সিন উঠলেই বাজাতে শুরু করবেন। প্রথম সিনে ছিল সবার আগে ডাকাতের সর্দার অক্ষয়বাবু এক পাশ থেকে একটা হুংকার দিয়ে স্টেজে ঢুকবেন। পিছু পিছু দ্বিতীয় ডাকাত আমি, এই দুটি কমিক দস্যু, পরে একে-একে অন্য ডাকাতরা ঢুকবে। সব ঠিক; ঘণ্টা বাজল, বনদেবীরা ঘুরে ঘুরে গান করে গেল।
সিন উঠল। এখন অক্ষয়বাবুর পালা, তিনি কেন জানি না, পাশ থেকে স্টেজে না ঢুকে ও-পাশ দিয়ে ঘুরে মাঝখান দিয়ে ভিতর থেকে ‘রী-রে-রে’ বলে হাঁক দিয়ে যেই তেড়ে বেরিয়েছেন, নিতুদ অনেক-সব দড়িদড়ার কীর্তি করেছিলেন বলেছি, এখন তারই একটা দড়িতে অক্ষয়বাবুর গলা গেল বেধে। কিছুতেই আর খোলে না, কেমন যেন আটকে গেছে। যতই মাথাঝাঁকানি দেন, উঁহু, দড়ি খোলে না। মহা বিপদ, আমি পিছন থেকে আস্তে আস্তে দড়িটা তুলে দিতেই অক্ষয়বাবু এক লাফে স্টেজের সামনে গিয়ে গান ধরলেন—
আঃ বেঁচেছি এখন।
শৰ্মা ওদিক আর নন।
গোলেমালে ফাঁকতালে…সটকেছি কেমন
সা—ফ্, সটকেছি কেমন।
এই গান গাইতেই, আর তার উপর অক্ষয়বাবুর গলা, চার দিক থেকে হাততালি পড়তে লাগল। প্রথম গানেই এবারে মাৎ।
তার পর বৃষ্টি হল স্টেজে, আর সঙ্গে সঙ্গে গান
রিম ঝিম ঘন ঘন রে বরষে
পিছনে আয়না দিয়ে নানারকম আলো ফেলে বিদ্যুৎ দেখানো হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে কড়কড় করে আমি ভিতর থেকে টিন বাজাচ্ছি, দুটো দম্বেল ছিল, দম্বেল জানো তো? কুস্তিগিররা কুস্তি করে, লোহার ডাণ্ডার দু-পাশে বড়ো বড়ো লোহার বল, নিতুদা দোতলায় ছাদ থেকে সেই দম্বেল দুটাে গড়গড় করে এ-ধার থেকে ও ধার গড়াতে লাগলেন। সাহেব মেমরা তো মহা খুশি, হাততালির পর হাততালি পড়তে লাগল। যতদূর রিয়ালিস্টিক করা যায় তার চূড়ান্ত হয়েছিল।
এখন দস্যুরা ঢুকবে। আগেই তো বলেছি স্টেজে মাটি ভরাট করে গাছের ডাল পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। এখন, বৃষ্টিতে সব কাদা হয়ে গেছে। দাদা স্টেজে ঢুকেই তো দপাস করে পা পিছলে পড়ে গেলেন। পড়ে গিয়ে আর উঠলেন না, ওখানেই হাত-পা একটু তুলে বেঁকিয়ে ঐভাবেই পোজ দিয়ে রইলেন। আমরাও আশেপাশে সব যে যার পোজ দিয়ে বসলুম, লুটের জিনিস ভাগ হবে। দিনুকেও সেবারে নামিয়েছিলুম। দিনু তখন ছোটাে, ওর একটা পোষা ঘোড়া ছিল, রোজ ঘোড়ায় চড়ত। সেই ঘোড়ার পিঠে আমাদের লুটের মাল বোঝাই করে দিনু স্টেজে এল। আমরা সব লুটের মাল ভাগ করলুম, একজন আবার গিয়ে ঘোড়াকে একটু ঘাসটাসও খাওয়ালে। সে কী অ্যাকটিং যদি দেখতে। তার পর চলল আমাদের মদ খাওয়া, খালি শূন্য মাটির ভাঁড় থেকে মদ ঢালা-ঢালি করছি, গান হচ্ছে—
তবে ঢাল্ সুরা, ঢাল্ সুরা, ঢাল্ ঢাল্ ঢাল্!
আর খালি ভাঁড় মুখের কাছে ধরে ঢক্ ঢক্ করে হাওয়া পান করছি। এই সব করে কালীমূর্তির কাছে আমাদের নাচ। এই তখন সেই খোলা তলোয়ার ছোরা ঘুরিয়ে কাবুলীদের নাচ নেচে দিলুম আমরা। এই নাচ আমরা রিহার্সেলে কম কষ্ট করে শিখেছিলুম? মেজোজ্যাঠামশায় ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন। গান গেয়ে নাচতে নাচতে হয়রান হয়ে পড়তুম তবুও থেমে যাবার জো নেই, থেমেছি কী মেজোজ্যাঠামশায় পিছন থেকে ছড়ি দিয়ে খোঁচা মারতেন। মহা মুশকিল, যে-জায়গায় খোঁচা মারতেন পিঠটা পাটা একটু রগড়ে নিয়ে আবার উদাম নৃত্য জুড়ে দিতুম। আর কী গান সেই নাচের সঙ্গে বুঝে দেখো—