কী বলছিলুম যেন, খামখেয়ালী উঠে যাবার কথা, কেন উঠে গেল। বলি শোনো।
এখন, কথা ছিল যে প্রত্যেক সভ্যের বাড়ি এক-একবার খামখেয়ালীর খাস মজলিস হবে। মজলিসে কী কী পড়া হবে, কী ভাবে খাওয়ানো, কে গান করবে, বাজনা ইত্যাদি সব-কিছুরই ভার সেই সভ্যের উপরেই সেবারকার মতো থাকে। তা, প্রায় সবারই বাড়ি একটা করে অধিবেশন হয়ে গেছে, শেষবার আমাদের এক ইয়ং বিলেত-ফেরত বন্ধুর বাড়িতে মজলিস হবার পালা, তিনি তাঁর এক ক্লায়েন্টের বাগানবাড়ি নিলেন কলকাতার বাইরে। আমাদের নেমন্তন্ন করলেন। মজলিসে খেয়ালীদের তো যেতেই হবে, সেই বাগানবাড়িতে আমরা সবাই গেলুম। গিয়ে দেখি কোনে কিছুরই ব্যবস্থা নেই। কত দিনের বন্ধ ঘর, তারই দু-একটা ঘর খুলে দিয়েছে— ভাপসা গন্ধ, নোংরা। আমরা সব বাইরে বাগানে পুকুরপাড়ে এসে বসলুম। সেখানেই কিছু গানবাজনা পড়াশুনো হল। রাতও দেখতে দেখতে বেশ হয়ে এল, কিন্তু খাবার আর আসে না। বসে আছি তো বসেই আছি। এক-একবার না পেরে দু-একজন উঠে গিয়ে বাগানের মালীকে জিজ্ঞেস করছি, কী রে, আর কত দেরি?
তারা বলে, ‘এই হচ্ছে, হল বলে’। এই হচ্ছে হল বলে আর খাবার তৈরি হয় না কিছুতেই। মহা মুশকিল, রাত বেড়ে চলেছে, পেট সবার খিদেয় চোঁ চোঁ করছে। এই করতে করতে শেষটায় খাবার এল, ডাক পড়ল আমাদের। উঠে গেলুম ভিতরে। আমি আশা করেছিলুম বিলেত-ফেরত বন্ধু, বেশ প্যাটি-ফ্যাটি খাওয়াবে বোধ হয়। দেখি লুচি আর পাঁঠার ঝোল এই সব করেছে। তাও যা রান্না, বোধ হয় রাস্তার মুদিখানা থেকে বামুন ধরে আনা হয়েছিল। সে যা হোক, কোনোমতে কিছু কিছু মুখে দিয়ে সবাই উঠে পড়লুম। রাত তখন প্রায় বারোটা। সেবারকার মজলিস যতদূর ডিপ্রেসিং ব্যাপার হতে হয় তাই হয়েছিল। ফিটন গাড়িতে চড়লুম, রবিকাকা বললেন ‘ছাদ খুলে দাও।’ গাড়ির ছাদ খুলে দেওয়া হল। আকাশে তখন সরু চাঁদ উঠেছে, ঠাণ্ডা হাওয়া ঝির ঝির করে বইছে। ফিটন চলতে লাগল, আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলুম। রবিকাকা বললেন, না, এ একটু বেশিরকম খামখেয়ালী হয়ে যাচ্ছে, এ-রকম করে চলবে না।
সেই থেকে কমিটি সৃষ্টি হল। কমিটির উপর ভার পড়ল, তারাই সব ঠিক করে দেবে মজলিসে কী হবে না হবে। কমিটি মানেই তে৷ ডাক্তার ডাকা। আমরাও কমিটির হাতে ভার দিয়ে আস্তে আস্তে যে যার সরে পড়লুম। এইভাবে ওটা চাপা পড়ে গেল। নইলে অনেক কাজ হয়েছিল, সে-সময়ে রবিকাকার ভালো ভালো বই বেরিয়েছিল। তার পর ভূমিকম্প, স্বদেশী হুজুগ; আমি চলে গেলুম আর্ট স্কুলে, রবিকাকা চলে গেলেন বোলপুরে, সব যেন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। তার অনেক কাল পরে এই লাল বাড়িতে ‘বিচিত্রা’র সৃষ্টি হয়।
১০. এইবারে বড়ো বাল্মীকিপ্রতিভার গল্প শোনো
এইবারে বড়ো বাল্মীকিপ্রতিভার গল্প শোনো। বড়ো বলছি এইজন্য, ও-রকম মহা ধুমধামে বাল্মীকিপ্রতিভা হয় নি আর। রবিকাকা তখন আমাদের দলের হেড, সাজপোশাক স্টেজ আঁকবার ভার আমাদের উপরে। ঐ সেবার থেকেই ও-সব কাজ আমাদের হাতে পেলুম। তার কিছুকাল আগে একবার বাল্মীকিপ্রতিভা নাটক.করে আদিব্রাহ্মসমাজের জন্য এক পত্তন টাকা তোলা হয়ে গেছে। বেশ কয়েক হাজার টাকা উঠেছিল এই নাটক করে।
তা, এবারে কর্তাদাদামশায়ের কী খেয়াল, হল, লাটসাহেবের মেম লেডী ল্যান্সডাউনকে পার্টি দেবেন, হুকুম হল বাল্মীকিপ্রতিভা অভিনয় হবে।
বড়োরাও তাতে যোগ দিয়েছিলেন; মেজোজ্যাঠামশায় ছিলেন, জ্যোতিকাকামশায় ছিলেন। মেজোজ্যাঠামশায় তখন থাকেন বিরজিতলার বাড়িতে। সেখানেই আমাদের রিহার্সেল হবে। তিনি নিলেন রিহার্সেলের ভার। আমাদের মহাফুর্তি। মেজোজ্যাঠামশায়ের বাড়িতে রিহার্সেল মানেই তো খাওয়ার ধুম। খাইয়েও ছিলুম তখন খুব তা তো জানোই, বিকেল হতে না হতে সবাই ছুটতুম মেজোজ্যাঠামশায়ের বাড়ি। চা ও খাবার একপেট খেয়ে তার পর রিহার্সেল শুরু হত।
রবিকাকা সেজেছেন বাল্মীকি, আমরা সব ডাকাত, অক্ষয়বাবু দস্যু-সর্দার, বিবি লক্ষ্মী, প্রতিভাদিদি সরস্বতী, অভি হাতবাঁধা বালিকা। জোর রিহার্সেল চলছে।
সেখানে একদিন একটা কাপ্তেন এসেছিল, কাবুলীদের নাচ দেখালে। সে কী জবরদস্ত শরীর তাদের; টেনিস খেললে, তা এমন মার মারলে বল একেবারে গির্জে টপকে চলে গেল। তারা নেচেছিল খোলা তলোয়ার ঘুরিয়ে কাবুল দেশের হাজারী নাচ। এই যেমন তোমাদের সাঁওতাল নাচ আর কি, সেইরকম ওটা ছিল কাবুলী নাচ।
আমাদের তো রিহার্সেল তৈরি, সময়ও হয়ে এসেছে। যত-সব সাহেবসুবো, লাটসাহেবের মেম আসবে। আমরা সাজব ডাকাত। মেজোজ্যাঠামশায় বললেন, ও হবে না, খালি গায়ে ডাকাত সাজা হবে না।
কী করা যায়। আমি বললুম, তা হলে ঐ হাজারীদের মতো সাজ করা যাক। সবাই খুশি, বললেন, এ ঠিক হবে। ডাকো দরজী। আগে ছিল ডাকাতদের খালি গা, বুকে সরু শালুর ফেটি। দরজী এসে আমাদের সাজ করতে লাগল, কাবুলীদের মতো গায়ে সেইরকম পাঞ্জাবি, পা অবধি কাবুলী পাজামা। আমাদের মহা উৎসাহ, ভাবছি এবারে আমরা ডাকাত সেজে দেখাব সবাইকে, ডাকাত কাকে বলে।
মহা সমারোহে স্টেজ সাজানো হল। নিতুদা নিলেন স্টেজ সাজাবার ভার। অনেক কারিকুরি করলেন তিনি স্টেজে। মাটি দিয়ে উঠোনের খানিকটা অর্ধচন্দ্রাকারে ভরাট করলেন। সেই থেকে সেই চাতালটা রয়ে গেছে। বটগাছ তো আগেই সাবাড় হয়েছিল, যা ছিল কিছু বাকি এনে পুঁতলেন, বনজঙ্গল বানালেন সেই মাটিতে। স্টেজে সত্যিকার বৃষ্টি ছাড়া হবে, দোতলার বারান্দা থেকে টিনের নল সোজা চলে গেজে স্টেজের ভিতরে। নানারকম দড়িদড়া বেঁধে গাছপালা উপরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সিন বুঝে সেগুলি নামিয়ে দেওয়া হবে। পদ্মবন, শোলার পদ্মফুল, পদ্মপাতা বানিয়ে নেটের মতো পাতলা গজের পর্দা পর-পর চার-পাঁচটা স্তরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রথমটা বেশ ঝাপসা কুয়াশার মতো দেখাবে, পরে এক-একটা পর্দা উঠে যাবে, ওপাশ থেকে আস্তে আস্তে আলো ফুটবে আর একটু একটু করে পদ্মবনে সরস্বতী ক্রমশ প্রকাশ পাবে।