খাস মজলিসের কর্মসূচী যতটা মনে পড়ে এইভাবে লেখা থাকত, একটা নমুনা দিচ্ছি—
১৩০৩
স্থান জোড়াসাঁকো।
নিমন্ত্রণকর্তা—শ্রীবলেন্দ্রনাথ ঠাকুর
অনুষ্ঠান। শ্রীগগনেন্দ্রনাথ কর্তৃক ‘অরসিকের স্বর্গপ্রাপ্তি’ আবৃত্তি। শ্রীরবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ও ‘মানভঞ্জন’-নামক গল্প পাঠ। গোঁসাইজির গান ও তাঁহার দাদার সংগত। গীতবাদ্য।
আহার। ধূপধুনা রসুনচৌকি সহযোগে তাকিয়া আশ্রয় করিয়া রেশমবস্ত্রমণ্ডিত জলচৌকিতে জলপান।
অভ্যাগতবর্গ। শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন দাশ
শ্রীযুক্ত অতুলপ্রসাদ সেন
শ্রীযুক্ত অমিয়নাথ চৌধুরী
শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রীযুক্ত অরুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর
অভ্যাগত আরো অনেকেই ছিলেন—শ্রীযুক্ত উমাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত সতীশরঞ্জন দাশ, শ্রীযুক্ত মনোমোহন ঘোষ, শ্রীযুক্ত মহিমচন্দ্র বর্মা, শ্রীযুক্ত করুণাচন্দ্র সেন, শ্রীযুক্ত নীরদনাথ মুখোপাধ্যায়। এঁরা অনেকেই নিমন্ত্রিত হিসেবে আসতেন।
খাস মজলিসে আহারও আমাদের এক-এক বার এক-এক ভাবে সাজিয়ে দেওয়া হত। কোনো বার ‘ফরাসে বসিয়া প্লেটপাত্রে মোগলাই খানা’, কখনো ‘টেবিলে জলপান’, কোনো বার বা ‘সাদাসিদে বাংলা জলপান’।
এই খামখেয়ালীর যুগে আমাদের বেশ একটা আর্টের কাল্চার চল্ছিল। নিমন্ত্রণপত্রও বেশ মজার ছিল। একটা স্লেট ছিল, সেটা পরে দারোয়ানরা নিয়ে রামনাম লিখত, সেই স্লেটটিতে রবিকাকা প্রত্যেক বারে কবিতা লিখে দিতেন, সেইটি সভার সভ্য ও অভ্যাগতদের বাড়ি বাড়ি ঘুরত। ঐ ছিল খামখেয়ালীর নেমন্তন্ন পত্র। নেমন্তন্নের কয়েকটি কবিতা এখনো আমার মনে আছে।
শ্রাবণ মাসের ১৩ই তারিখ শনিবার সন্ধ্যাবেলা
সাড়ে সাত ঘটিকায় খামখেয়ালীর মেলা।
সভ্যগণ জোড়াসাঁকোয় করেন অবরোহণ
বিনয়বাক্যে নিবেদিছে শ্রীরজনীমোহন।
আর-একবার ছিল—এ থেকেই বুঝতে পারবে আমাদের খাস মজলিসে কী কী কাজ হত—
শুন সভ্যগণ যে যেখানে থাকো,
সভা খামখেয়াল স্থান জোড়াসাঁকো।
বার রবিবার রাত সাড়ে সাত,
নিমন্ত্রণকর্তা সমরেন্দ্রনাথ।
তিনটি বিষয় যত্নে পরিহার্য—
দাঙ্গা, ভূমিকম্প, পুণা-হত্যাকার্য।
এই অনুরোধ রেখে খামখেয়ালী,
সভাস্থলে এসো ঠিক punctually।
আরো সব বেড়ে মজার কবিতা ছিল—
এবার
খামখেয়ালীর সভার
অধিবেশন হবার
স্থান কিছু দূরে
সেই আলিপুরে।
নির্মল সেন
সবে ডাকিছেন।
শনিবার রাত
ঠিক সাড়ে সাত।
দাঁড়াও, আরো একটা মনে পড়ছে। দেখো তো, কথায় কথায় কেমন সব মনে আসছে একে-একে। কে জানত আমার আবার এও মনে থাকবে। সেবার এখানেই হয় খামখেয়ালীর অধিবেশন, এই জোড়াসাঁকোতেই—
এতদ্বারা নোটিফিকেশন
খামখেয়ালীর অধিবেশন
চৌঠা শ্রাবণ শুভ সোমবার
জোড়াসাঁকো গলি ৬ নম্বার।
ঠিক ঘড়ি ধরা রাত সাড়ে সাত
সত্যপ্রসাদ কহে জোড় হাত।
যিনি রাজী আর যিনি গররাজী
অনুগ্রহ করে লিখে দিন আজই।
এই-সব কাণ্ডকীর্তি আমাদের হত তখন। আমাকে রবিকাকা বললেন, অবন, তোমাকেও কিছু লিখতে হবে। কিছুতেই ছাড়েন না। আমি খামখেয়ালীতে প্রথম পড়ি ‘দেবীপ্রতিমা’ বলে একটা গল্প। পুরোনো ‘ভারতী’তে যদি থেকে থাকে খোঁজ করলে পাওয়া যেতে পারে। রবিকাকা আমাকে প্রায়ই বলতেন, অবন, তোমার সেই লেখাটি কিন্তু বেশ হয়েছিল।
রবিকাকাও সে-সময় অনেক গল্প কবিতা খামখেয়ালীর জন্য লিখেছিলেন। সেই খামখেয়ালীর সময়েই ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ লেখা হয়। খামখেয়ালীতে পড়া হল, ঠিক হল আমরা অভিনয় করব। কেদার হলেন রবিকাকা, মতিলাল চক্রবর্তী সাজলেন চাকর, দাদা বৈকুণ্ঠ, নাটােরের মহারাজা অবিনাশ, আমি সেই তিনকড়ি ছোকরা। ঐ সেবারেই আমার অভিনয়ে খুব নাম হয়। তখন আরো মোটা আর লম্বা-চওড়া ছিলুম অথচ ছোকরার মতো চট্পটে, মুখেচোখে কথা; রবিকাকা বললেন, অবন, তুমি এত বদলে গেলে কী করে।
একটা বোতাম-খোলা বড়ো ছিটের জামা গায়ে, পানের পিচ্কি বুকময়। মা বলতেন, তুই এমন একটা হতভাগা-বেশ কোত্থেকে পেলি বল্ তো! এক হাতে সন্দেশের ঝুড়ি, আর-এক হাতে খেতে খেতে স্টেজে ঢুকছি, রবিকাকার সঙ্গে সমানে সমানে কথা কইছি, প্রায় ইয়ার্কি দিচ্ছি খুড়ো-ভাইপোতে। প্রথম প্রথম বড়ো সংকোচ হত, হাজার হোক রবিকাকার সঙ্গে ও-রকম ভাবে কথা বলা, কিন্তু কী করব—অভিনয় করতে হচ্ছে যে। কথা তো সব মুখস্থ ছিলই, তার উপর আরো বানিয়ে টানিয়ে বলে যেতে লাগলুম। রবিকাকা আর থৈ পান না। আমাদের সেই অভিনয় দেখে গিরিশ ঘোষ বলেছিলেন, এ-রকম অ্যাক্টার সব যদি আমার হাতে পেতুম তবে আগুন ছিটিয়ে দিতে পারতুম।
একদিন রবিকাকা পার্ট ভুলে গেছেন, স্টেজে ঢুকেই এক সিন বাদ দিয়ে ‘কী হে তিনকড়ি’ বলে কথা শুরু করে দিলেন। আমি চুপিচুপি বলি, বাদ দিলে যে রবিকাকা, প্রথম সিনটা। তা, তিনি কেমন করে বেশ সামলে গেলেন।
জ্যোতিকাকা করেছিলেন আরো মজার—পার্ক স্ট্রীটে কী একটা প্লে হচ্ছে, স্টেজে ঢুকেছেন, ঢুকে নিজের পার্ট ভুলে গেছেন। তিনি সোজা উইংসের পাশে গিয়ে সকলের সামনেই জিজ্ঞেস করলেন, কী হে, বলে দাও-না আমার পার্টটা কী ছিল, ভুলে গেছি যে।
এই তো গেল নানা ইতিবৃত্ত।
কিছুকাল বাদে খামখেয়ালীও উঠে যায়। কেন যে উঠে যায় তার একটা গল্পও আছে। বলব তোমাকে সব? কী জানি শেষে না আবার বন্ধুমানুষ কেউ কেউ ক্ষুণ্ণ হন। যাক গে, নাম বলব না কারুরই, গল্প শুনে রাখো। আমার আর কয়দিন, যা-কিছু আমার কাছে আছে সব তোমার কাছে জমা দিয়ে যাই। অনেক কথাই কেউ জানে না, আমি চলে গেলে আর জানবার উপায়ও থাকবে না। দরকার মনে করো যদি জানিয়ো তাদের আমি তোমার কাছে বলেই খালাস; এর পর তোমার যা ইচ্ছে কোরো।