কর্তাদিদিমা ভাবছেন, ভাইয়ের কী হল। কর্তাদাদামশায়েরও ভাবনা হল, তাই তো তিন দিন লোকটার দেখা নেই, সঙ্গে টাকাকড়ি আছে, কিছু বিপদ-আপদ ঘটল না কি। তখনকার দিনে নানা রকম ভয়ের কারণ ছিল। পুলিসে খবর দিলেন। পুলিস এদিক-ওদিক খোঁজখবর করছে। এমন সময়ে তিন দিন বাদে ব্রজরায় মামা মুটের মাথায় করে মস্ত এক তালমিছরির কুঁদো এনে উপস্থিত।
এখন হয়েছে কী, ব্রজরায় মামা বাজারে ভালো তালমিছরি খুঁজতে খুঁজতে কিছুতেই মনের মতো ভালো তালমিছরি পান না, বাজারেরই কেউ একজন বুঝি বলেছে যে বর্ধমানে ভালো মিছরি পাওয়া যাবে। ব্রজরায় মামা সেখান থেকেই সোজা টিকিট কেটে বর্ধমান চলে গেছেন, সেখানে গিয়ে এ-গাঁ ও-গাঁ ঘুরে তিন দিন বাদে মিছরির কুঁদো এনে হাজির। কর্তাদাদামশায় হাসবেন কি কাঁদবেন ভেবে পান না। সেই ব্রজরায় মামার ছোটাে ভাই জগদীশমামা, বুঝে দেখো ব্যাপার।
তা ‘রাজা ও রানী’র রিহার্সেল চলছে, রবিকাকা মেজোজ্যাঠাইমা সবাই ধরলেন, জগদীশমামা তুমিও নেমে পড়ো। একজনই ঘুরেফিরে আসার চেয়ে নতুন নতুন লোকের নতুন নতুন ক্যারেক্টার থাকবে। আমিও খুব উৎসাহী। বললুম, খুব ভালো হবে। জগদীশমামা বললেন, না দাদা, ভুলেটুলে যাব শেষটায়! আমি বললুম, কিছু ভুল হবে না, সময়মত আমি তোমাকে খোঁচা দেব, পিছন থেকে বলে দেব, তুমি ভেবে না।
এখন জনতার মধ্যে দুটি কথা, আধখানি লাইন বলতে হবে জগদীশমামার। রবিকাকা আবার বড়ো বড়ো করে লিখে দিলেন। আমরা তাকে রিহার্সেল দেওয়ালুম। কথা হচ্ছে জনতার মধ্যে একবার শুধু জগদীশমামা বলবেন যে ‘তা আপনারা পাঁচজনে যা বলেন।’ রোজ রিহার্সেলের সময় হলেই আগে থাকতে জগদীশমামা পার্ট মুখস্থ করতে থাকেন। একে ওকে বলেন, ‘দেখো তো ভাই, ঠিক হচ্ছে কিনা, ভুলে যাচ্ছি না তো?’ আর রোজই রিহার্সেলে ওঁর কথা-কয়টি বলবার সময় হলেই সব ভুলে যেতেন, আমি এদিক-ওদিক থেকে খোঁচা দিতে থাকতুম, জগদীশমামা, এবারে বলো তোমার পার্ট। উনি ঘাবড়ে গিয়ে কথাটি ভুলে যেতেন; বলতেন, ‘তা তোমরা যা বলো দাদা, তা তোমরা যা বলো।’
রোজই এই কাণ্ড হতে লাগল। আর সেই জনতার সিনে আমাদের সে যা হাসি! শেষে কোনো রকম করে শেষ পর্যন্ত তাঁকে পার্ট মুখস্থ করানো গেল, কিন্তু পাঁচজনের পাঁচের চন্দ্রবিন্দু তার মুখে আসত না; বলতেন, ‘তা পাচজনে যা বলেন।’ তিনি আবার আমাদের গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করতেন, কেমন হল দাদা! আমরা বলতুম, অতি চমৎকার, এমন আর কেউ করতে পারত না। তিনি তো মহা খুশি।
রিহার্সেলে সে যা সব মজা হত আমাদের। রিহার্সেল ছেড়ে প্লেতে আর আমাদের জমত না। যেমন ছবি আঁকা, যতক্ষণ ছবি আঁকি আনন্দ পাই, ছবি হয়ে গেল তো গেল। এও তাই। রবিকাকা তাই পর পর একটা ছেড়ে আর-একটা লিখেই যেতেন। আমরা তো দিনকতক স্টেজেই ঘরবাড়ি করে ফেলেছিলুম। প্ল্যাটফর্ম পাতা থাকত, রোজ দুপুরে তাকিয়া পাখা পানতামাক নিয়ে সেখানেই আখড়াবাড়ির মতো সবাই কাটাতুম। মশগুল হয়ে থাকতুম ড্রামাতে। সে যে কী কাল ছিল। তখন রবিকাকার রোজ নতুন নতুন সৃষ্টি।
তার পর এই বাড়িতেই ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যকে ‘বিসর্জন’ নাটক দেখানো হয়, পুরানো সিন তৈরি ছিল সেই-সব খাটিয়েই। আমাদেরও পার্ট মুখস্থ ছিল। রবিকাকা পার্ট নিয়েছিলেন রঘুপতির, অরুদা জয়সিংহের, দাদা রাজার, অপর্ণা এ বাড়িরই কোনো মেয়ে মনে নেই ঠিক। বালক বালিকা, তাতা আর হাসি, বোধ হয় বিবি আর সুরেন, তাও ঠিক মনে পড়ছে না।
এইখানে একটা ঘটনা আছে। রবিকাকাকে ও রকম উত্তেজিত হতে কখনো দেখি নি। এখন, রবিকাকা রঘুপতি সেজেছেন, জয়সিংহ তো বুকে ছোরা মেরে মরে গেল। স্টেজের এক পাশে ছিল কালীমূর্তি বেশ বড়ো, মাটি দিয়ে গড়া। কথা ছিল রঘুপতি দূর দূর বলে কালীর মূর্তিকে ধাক্কা দিতেই, কালীর গায়ে দড়াদড়ি বাধা ছিল, আমরা নেপথ্য থেকে টেনে মূর্তি সরিয়ে নেব। কিন্তু রবিকাকা করলেন কী, উত্তেজনার মুখে দূর দূর বলে কালীর মূর্তিকে নিলেন একেবারে দু হাতে তুলে। অত বড়ো মাটির মূর্তি দু হাতে উপরে তুলে ধরে স্টেজের এক পাশ থেকে আর-এক পাশে হাঁটতে হাঁটতে একবার মাঝখানে এসে থেমে গেলেন। হাতে মূর্তি তখন কাঁপছে, আমরা ভাবি কী হল রবিকাকার, এইবারে বুঝি পড়ে যান মূর্তিসমেত। তার পর উইংসের পাশে এসে মূর্তি আস্তে আস্তে নামিয়ে রাখলেন। তখনো রবিকাকার উত্তেজিত অবস্থা। জানো তো তাঁকে, অভিনয়ে কী রকম এক-এক সময়ে উত্তেজনা হয় তাঁর। আমরা জিজ্ঞেস করলুম, কী হল রবিকাকা তোমার। ঐ অতবড়ো কালীমূর্তি দু হাতে একেবারে তুলে নিলে?
উনি বললেন, কী জানি কী হল, ভাবলুম মূর্তিটাকে তুলে একবারে উইংসের ভিতর ছুঁড়ে ফেলে দেব। উত্তেজনার মুখে মূর্তি তো তুলে নিলুম, ছুঁড়তে গিয়ে দেখি ও পাশে বিবি না কে যেন হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে; এই মাটির মূর্তি চাপা পড়লে তবে আর রক্ষে নেই—হঠাৎ সামলে তো নিলুম, কিন্তু কোমর ধরে গেল।
তার পর অতি কষ্টে এ পাশে এসে রবিকাকা কোনো রকম করে মূর্তি নামান। সেই কোমরের ব্যথায় মাসাবধি কাল ভুগেছিলেন।
এর পরে সব শেষে হল ‘খামখেয়ালী’। ড্রামাটিক ক্লাব নিয়ে নানা হাঙ্গামা হওয়ায় এবারে রবিকাকা ঠিক করলেন বেছে বেছে গুটিকতক খেয়ালী সভ্য নেওয়া হবে, অন্যান্যরা থাকবেন অভ্যাগত হিসাবে। নাম কী হবে, রবিকাকা ভাবছেন ‘খেয়ালী সভা’ ‘খেয়ালী সভা’। আমি বললুম, নাম দেওয়া যাক খামখেয়ালী। রবিকাকা বললেন, ঠিক বলেছ, এই সভার নাম দেওয়া যাক খামখেয়ালী। ঠিক হল প্রত্যেক সভ্যের বাড়িতে মাসে একটা খামখেয়ালীর খাস মজলিস হবে, আর সভ্যেরা তাতে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু পড়বেন। প্রত্যেক অধিবেশনের শেষে রবিকাকা একটা খাতায় নিজের হাতে বিবরণী লিখে রাখতেন। সেই খাতাটি আমি রথীকে দিয়েছি, দেখো তাতে অনেক জিনিস পাবে।