গাড়িবারান্দায় স্টেজ বাঁধা হল। এক রাত্তিরে ড্রেস রিহার্সেল হচ্ছে, ঘরের লোকই সব জমা হয়েছে। পরের দিন অভিনয় হবে। মেজোজ্যাঠামশায়ের মেজাজ তো, মুখে যা আসত টপাস করে বলে ফেলতেন। এখন, অক্ষয়বাবু ত্রিবেদীর পার্ট করছেন, ড্রেস রিহার্সেলে বেশ ভালোই করছিলেন। কিন্তু মেজোজ্যাঠামশায়ের পছন্দ হল না, মেরে দিলেন তিন তাড়ী—এ কি কমিক হচ্ছে!
সব চুপ, কারো মুখে কথা নেই, আমরাও থ। মেজোজ্যাঠামশায়ের মুখের উপরে কথা বলে কার এত সাহস।
রবিকাকা আমাদের ফিসফিস করে বললেন, দেখলে মেজদার কাণ্ড, হল এবারের মতো অভিনয় করা।
অক্ষয়বাবুর মুখে ঝোড়া নামল। কথা নেই, মুখ নিচু করে বসে রইলেন। খানিক বাদে মেজোজ্যাঠাইমা বললেন, তা, তুমি ওঁকে বলে দাও-না কী রকম করতে হবে। কাল অভিনয় হবে, আজ যদি এ রকম বন্ধ হয় তা হলে চলবে কী করে। তখন অক্ষয়বাবুও বললেন, হ্যাঁ, তাই বলো কী করে অভিনয় করতে হবে, আমি তাই করছি। এই বলে রবিকাকার দিকে চাইলেন, রবিকাকা একটু চোখ টিপে দিলেন। তিনি আবার বললেন, আমি বুঝতে পারছিলুম যে ঠিক হচ্ছিল না, তা তুমি আমাকে দেখিয়ে দাও, আমি নাহয় আবার করছি এই পার্ট। অক্ষয়বাবু অতি বিনীত ভাব ধারণ করলেন।
মেজোজ্যাঠাইমা রবিকাকা সবাই বুঝলেন, ব্যাপার সুবিধের নয়, অক্ষয়বাবু এবারে কিছু খসাবেন।
মেজোজ্যাঠামশায় বললেন, করো তা হলে আবার গম্ভীর হয়ে পার্ট করে, এ তো আর হাসিতামাশা নয়।
আবার সেই সিন শুরু হল। আমাদের যাদের সেই সিনে পার্ট ছিল—রবিকাকা আমরা— উঠলুম; সবার পার্ট যে যেমন করি তাই করে গেলুম। অক্ষয়বাবু খুব গম্ভীর মুখে স্টেজে ঢুকলেন; পার্ট বলে গেলেন আগাগোড়া, তাতে না দিলেন কোনো অ্যাক্সেণ্ট না কোনো ভাব বা কিছু। সোজা গম্ভীর মুখে গড়গড় করে কথা কয়ে গেলেন। সিংহীকে লেজ কেটে দিলে রোঁয়া ছেঁটে দিলে যেমন হয় ত্রিবেদীর পার্ট ঠিক সেই রূপে দেখা দিল।
মেজোজ্যাঠাইমা মেজোজ্যাঠামশায়কে বললেন, তুমি কেন বলতে গেলে, এর চেয়ে আগেই তো ছিল ভালো।
অক্ষয়বাবু বললেন, আমি সাধ্যমত করেছি, এবার তা হলে আমাকে বিদেয় দাও,বুড়ো হয়ে গেছি, ছেলেছোকরা কাউকে দিয়ে নাহয় এই পার্ট করাও। বলে আমার দিকে চাইতেই আমি হাত নেড়ে বারণ করলুম। লোভ যে ছিল না ত্রিবেদীর পার্ট করতে তা নয়, হয়তো দিলে ভালোই করতে পারতুম।
অক্ষয়বাবু বললেন, আর এখানে রোজ যাওয়া-আসায় আমারও তো একটা খরচ আছে, আমি আর পারি নে।
কী আর করা যায় এখন, এই একদিনের মধ্যে তো নতুন লোক তৈরি করা সম্ভব নয়। সেই রাত্রে অক্ষয়বাবু নগদ পঞ্চাশ টাকা পকেটে ক’রে— বর্ষা নেমেছে শীত শীত ক’রে একখানা গায়ের চাদর ঘাড়ে করে—বাড়ি ফিরলেন।
সেবার রাজা ও রানী অভিনয় খুব জমেছিল। সবাই যার যার পার্ট অতি চমৎকার করেছিলেন। লোকের যা ভিড় হত। আমার মন খুঁত খুঁত করত বাইরে থেকে দেখতে পেতুম না বলে। ছটা পার্ট ছিল আমার, একটা পার্ট করে পরের সিনে আবার তক্ষুনি তক্ষুনি সাজ বদল করে আর-একটা পার্ট করতে আমার গলদঘর্ম হয়ে যেত। তার উপরে আবার যখন একটু দাঁড়াতুম, সুরেন্দ্র বাঁড়ুজ্জের ভাই জিতেন বাঁড়ুজ্জে কুস্তিগীর, বিরাট শরীর, মহা পালোয়ান, সে আমার স্কন্ধে ভর দিয়ে অভিনয় দেখত—আমার ঘাড় ব্যথা হয়ে গিয়েছিল।
একদিন আবার আর-এক কাণ্ড— অভিনয় হচ্ছে, হতে হতে ড্রপসিন পড়বি তো পড় একেবারে মেজোজ্যাঠাইমার মাথার উপরে প্রায়। রবিকাকা তাড়াতাড়ি মেজোজ্যাঠাইমাকে টেনে সরিয়ে আনেন। আর-একটু হলেই হয়েছিল আর কী!
রাজা ও রানী বোধ হয় আর অভিনয় হয় নি। পরে, এমারেল্ড থিয়েটার রাজা ও রানী নিয়েছিল। পাবলিক অ্যাক্টার অ্যাক্ট্রেস অভিনয় করে। গিরিশ ঘোষ ছিলেন তখন তাতে, সে আবার এক মজার ঘটনা। এখন, আমাদের যখন রাজা ও রানী অভিনয় হয় সে সময়ে একদিন কী করে পাবলিক অ্যাক্ট্রেসরা ভদ্রলোক সেজে অভিনয় দেখতে ঢুকে পড়ে। আমরা কেউ কিছু জানি নে। আমরা তো তখন সব ছোকরা, বুঝতেই পারি নি কিছু। তারা তো সব দেখেশুনে গেল। এখন পাবলিক স্টেজে রাজা ও রানী অভিনয় করবে, আমাদের নেমন্তন্ন করেছে। আমরা তো গেছি, রানী সুমিত্রা স্টেজে এল, একেবারে মেজোজ্যাঠাইমা। গলার স্বর, অভিনয়, সাজসজ্জা, ধরনধারণ, হুবহু মেজোজ্যাঠাইমাকে নকল করেছে। মেয়েদের আরো অনেকের নকল করেছিল, রবিকাকাদের নকল করতে পারবে কী করে। ছেলেদের পার্ট ততটা নিতে পারে নি। কিন্তু মেজোজ্যাঠাইমার সুমিত্রাকে যেন সশরীরে এনে বসিয়ে দিলে। অদ্ভূত ক্ষমতা অ্যাক্ট্রেসদের, অবাক করে দিয়েছিল।
রিহার্সেলেই আমাদের মজা ছিল। বিকেল হতে না হতেই রোজ মেজোজ্যাঠামশায়ের বাড়ি যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া, গল্পগুজব, রিহার্সেল, হৈ-চৈ, ঐতেই আমাদের উৎসাহ ছিল বেশি। অভিনয় হয়ে গেলে পর আমাদের আর ভালো লাগত না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকত সব। তখন ‘কী করি’ ‘কী করি’ এমনি ভাব। রবিকাকা তো থেকে থেকে পরগনায় চলে যেতেন, আমরা এখানেই থাকি—আমাদেরই হত মুশকিল। আর, কত রকম মজার মজার ঘটনাই হত আমাদের রিহার্সেলের সময়ে। সেবারে‘রাজা ও রানী’র রিহার্সেলের সময় আমাদের জমেছিল সব চেয়ে বেশি। ছেলেবুড়ো সব জমেছি সেই অভিনয়ে। অনেক জনতার পার্ট ছিল। বলেছি তো আমাকেই ছ-ছটা পার্ট নিতে হয়েছিল, অত লোক পাওয়া যাবে কোথায়। জগদীশমামা ছিলেন, তারও উৎসাহ লেগে গেল। জগদীশমামা ভারি মজার মানুষ ছিলেন, সবারই তিনি জগদীশমামা, এই জগদীশমামা, কী রকম লোক ছিলেন শোনো। তার দাদা ব্রজরায় মামা, তিনিও এখানেই থাকতেন, তিনি তবু একটু চালাক-চতুর। তিনি ছিলেন ক্যাশিয়ার। একবার কর্তাদাদামশায় ব্রজরায় মামাকে ফরমাশ করলেন, ভালো তালমিছরি নিয়ে এসো। কর্তাদাদামশায়ের আদেশ, ব্রজমামা তখুনি বাজারে ছুটলেন টাকাকড়ি পকেটে নিয়ে। তিন দিন আর দেখা নেই।