অভিনয় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, অশ্রুমতী বেশ ভালো অভিনয়ই করেছিল, কিন্তু ওমা, তার পায়ের দিকে চেয়ে দেখি বকলস-দেওয়া বার্নিশ-করা জুতো! অশ্রুমতী হল রাজপুত রমণী, তার পায়ে এ জুতো কী! তবে তো এ আসল নয়, ঐ একটুখানি সাজের খুঁতে এত যে ইলিউশন সব ভেঙে গেল।
এই প্রথম আমার স্টেজে দেখা নাটক। তারপর বাড়ি এসে আমরা ছেলেরা কয়েক দিন অবধি কেবলই অশ্রুমতীর নাটক করছি নীচের বড়ো ঘরটিতে। কথাগুলো সব ঐ এক দিনের দেখাতেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
জ্যোতিকাকামশায়ের ‘সরোজিনী’ নাটকের যাত্রা হয়েছিল, যাত্রাওয়ালারা সেই যাত্রা করে। আমাদের বাড়ির উঠোনে একদিন যাত্রা দেখানো হয়েছিল। আমার মনে আছে, চিতোরের পদ্মিনী আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে—
জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ
আগুনে সঁপিবে বিধবা বালা।
আর ভৈরবী যখন দু হাত তুলে খাঁড়া হাতে ‘ম্যয় ভুঁখাহুঁ’ বলে বের হত তখন আমাদের বুকের ভিতর গুর্ গুর্ করে উঠত। জ্যোতিকাকামশায়ের সরোজিনী নাটকের পদ্মিনীর অগ্নিপ্রবেশের ছবি আর্ট স্টডিয়ো থেকে লিথোগ্রাফ প্রিন্ট হয়ে বেরিয়েছিল, ঘরে ঘরে সেই ছবি থাকত। দাদামশায়ের থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল, জ্যোতিকাকামশায়ে এসে ঠেকল। তখন জ্যোতিকাকামশায় নাট্যজগতে অদ্বিতীয়, অপ্রতিহত প্রতাপ তাঁর বইয়ের। বাজার ছেয়ে গিয়েছিল তাঁর বইয়ে বইয়ে। জায়গায় জায়গায় তাঁর নাটক অভিনয় হত। রবিকাকা তখন কোথায়। তখনো তিনি আসরে কল্কে পান নি।
আমাদের বাড়িতে নাটকের প্রথম ইতিহাস হল—নব-নাটকের বেলা অন্য লোকে বই লিখলেন, আমাদের বাড়ির লোকে প্লে করলেন। অশ্রুমতীর বেলা আমাদের বাড়ির লোকে বই লিখলেন, বাইরের লোকে প্লে করলেন। তার পরে হল রবিকাকার আমলে আমাদের ঘরের লোক লিখলেন, আমরাই ঘরের ছেলেমেয়েরা অভিনয় করলুম। এবারে আসবে সে গল্প।
৯. প্রথম বাড়িতে প্লে আরম্ভ হল
প্রথম বাড়িতে প্লে আরম্ভ হল জ্যোতিকাকামশায়ের ‘এমন কর্ম আর করব না’, ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’ ইত্যাদি। জ্যাঠামশায় পার্ট নিয়েছিলেন। সত্যসিন্ধুর। ‘মানময়ী’ও হয়েছিল। মানময়ী যে কার লেখা তা মনে নেই, কিন্তু গানের সুর জ্যোতিকাকার দেওয়া, ইংরেজি রকমের। এই সুরের অনেক আভাস ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’তেও আছে। তখন ঐ রকম ছোটোখাটো প্রহসনই হত বাড়িতে বড়োদের নিয়ে। ছোটোরা তার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারত না। এ বাড়ির খড়খড়ি টেনে দীপুদার নীচের বৈঠকখানা বেশ দেখা যায়। আমরা সেই খড়খড়ি টেনে মাঝে মাঝে দেখতুম, ম-পিসিমারাও রাত-বিরেতে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন। রাত্রির অন্ধকারে কে আর আমাদের দেখতে পাচ্ছে।
বঙ্কিমবাবুও আসতেন সে সময়ে। একদিন দেখি বঙ্কিমবাবু মাথায় পাকানো চাদরের পাগড়ি বেঁধে লাঠি ঘুরিয়ে কী যেন করছেন। আর তাঁর চেহারাও ছিল অতি সুন্দর। ঐ তাঁর এক রূপ আমার মনে আছে। ও-সব ছিল নিছক বৈঠকখানার ব্যাপার।
তার পর ওঁরা বাল্মীকিপ্রতিভা অভিনয় করলেন, তখন বাড়ির মেয়েদের ডাক পড়ল। ঋতুকে ছেলে সাজানো হল। প্রতিভাদিদি সরস্বতী সাজলেন, রবিকাকা সাজলেন বাল্মীকি ঋষি। সারদাপিসেমশায়, কেদারদাদা, অক্ষয়বাবু, এরা সব সেজেছিলেন বড়ো বড়ে ডাকাত। থেকে থেকে বাল্মীকিপ্রতিভা অভিনয় হয়। আমরা আর দেখতে পাই নে—ঐ যে বললুম, ছোটোদের বড়োদের কাছে ঘেঁষবার হুকুম ছিল না।
একদিন বাবামশায় পার্টি দেবেন, খাওয়া-দাওয়া হবে, লোকজনদের নেমন্তন্ন করা হয়েছে, তাতে বাল্মীকিপ্রতিভাও অভিনয় হবে। মহা ধুমধাম। তেতলার ছাদ চার দিকে রেলিং আর পিলপে দেওয়া, ঘেরা, তারই উপরে চালা বেঁধে স্টেজ তৈরি হল। তখন তো ইলেকট্রিক বাতি ছিল না, গ্যাসের বাতির ব্যবস্থা হয়েছে। সমাজ থেকে হারমোনিয়াম আনা হল। আমরা সকাল থেকে সারদাপিসেমশায়কে ধরেছি একবার আমাদের জন্য দরবার করতে, অভিনয় দেখব। সারা দিন তাঁর পিছু পিছু ঘুরছি, ও বাড়ির বারান্দায় পিসেমশায়কে দেখলেই এ বাড়ি থেকে দু হাত কচলে আমাদের আবেদন জানাই। তিনি বলেন, হবে হবে। এই করতে করতে অনেক কষ্টে প্রায় বিকেলবেলা পেয়ে গেলুম অনুমতি। সারদাপিসেমশায় বললেন, হয়েছে, তোমাদের দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছে, আজ দেখতে পাবে তোমরা।
আমাদের উৎসাহ দেখে কে। সরল তখন ছোটো, সে আমাদের দলেই। আমরা বিকেল থেকে জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে আছি, বিকেলের জলখাবার কোনো রকমে একটু মুখে দিলুম। তখন কি আমাদের খিদেতেষ্টার দিকে মন আছে। অভিনয় হবে রাত সাতটা-আটটার সময়ে, আমরা ছয়টা থেকে তৈরি হয়ে আছি। হবি তো হ, ছয়টার পর থেকেই হঠাৎ ঝঞ্ঝাবাত, দারুণ ঝড় শুরু হল। আর সঙ্গে সঙ্গে সে কী বৃষ্টি, মনে হল যেন বাড়ি পড়ে যায় আর কী। খোল্ খোল্, পাল-দড়িদড়া কাট্, স্টেজ পড়ে যায়; শোভারাম দারোয়ান দড়িদড়া কাটতে গিয়ে পাল-চাপা পড়ল। গ্যাসের চাবি আর কেউ বন্ধ করতে পারে না, ঝড়ে বৃষ্টিতে সব একাকার। ঘণ্টা দুই চলল অমনি, আমরা তে হতাশ হয়ে পড়লুম। হল আর আমাদের অভিনয় দেখা।
বৃষ্টি থামলে সেই দড়িদড়া এনে নীচের বড়ো ঘরে স্টেজ বাঁধা হল, বারান্দায় হল খাবার ব্যবস্থা। আমাদের কি বের হতে দেয় আর। মনের দুঃখে কী আর করি, এত করে দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছিল, গেল সব পণ্ড হয়ে। সে রাত্রে হল কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাল্মীকিপ্রতিভা-অভিনয়, অতিথিরাও এলেন, খাওয়া-দাওয়া করলেন। সবই হল, কেবল আমাদের কপালেই অভিনয় দেখা হল না।