নটী আসল মুক্তোর মালা হীরের গয়না পরেছিলেন। সেই নট-নটী আবার তামাসা করে বাগানময় ঘুরে বেড়ালেন।
পাশের বাড়ির চাটুজ্জেমশায় ছিলেন বেজায় গোঁড়া, তিনি তো রেগে অস্থির। বলেন, এ কী ব্যাপার, মেয়েরা বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আর তো মান থাকে না, বলো গিয়ে ও বাড়িতে! তাঁকে যত বোঝানো হয় যে ও-বাড়ির জ্যোতিদাদা মেয়ে সেজেছে, তিনি বলেন, আমি স্বচক্ষে দেখেছি মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে বাগানে।
জ্যোতিকাকা ছিলেন পরম সুন্দর পুরুষ। নটী সাজবেন, সকাল থেকে বাড়ির মেয়েরা বিনুনি করছে, চুল আঁচড়ে দিচ্ছে গোলাপ তেল দিয়ে, বাড়ির পিসিমারাই সাজিয়ে দিয়েছিলেন ভিতর থেকে।
আর-একদিন নটী থিয়েটারের ভিতরে বসে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন, এমন সময় বেলী সাহেব ঢুকেছেন গ্রীনরুমে কাকে যেন অভিনন্দন করতে। ঢুকেই তিনি পিছু হটে এলেন, বললেন—জেনানা আছেন ভিতরে। শেষে যখন জানলেন জ্যোতিকাকামশায় নটী সেজে বসে বাজাচ্ছেন তখন হাসির ধুম পড়ে গেল। বলেন, কী আশ্চর্য! একটুও জানবার জো নেই, ঠিক যেন জেনানা বলে ভুল হয়।
সিনও যেখানে যেমনটি দরকার, পুকুরঘাট, রাস্তা, স্টেজ-আর্ট যতটুকু রিয়ালিস্টিক হতে পারে হয়েছিল। একটা বনের দৃশ্য ছিল, বাবামশায়ের ছিল বাগানের শখ, আগেই বলেছি। অন্ধকার বনের পথ, বাবামশায় মালীকে দিয়ে চুপি চুপি অনেক জোনাক পোকা জোগাড় করিয়েছিলেন, সেই বনের সিন এলেই বাবামশায় অন্ধকার বনপথে জোনাক পোকা মুঠো মুঠো করে ছেড়ে দিতেন ভিতর থেকে। মা বলতেন, সে বা দৃশ্য হত। বাবামশায় অমনি করে ফাইনাল টাচ দিয়ে দিতেন।
আমি তখন হই নি, দাদা বোধ হয় ছয় মাসের। আর কয়েকটা বছর আগে জন্মালে তোমাকে এই থিয়েটার সম্বন্ধে শোনা-গল্প না বলে দেখা-গল্পই বলতে পারতুম। বাড়ির জলসা শেষ হয়ে তখনো-গল্প চলছে নব-নাটক সম্বন্ধে আমাদের আমলে। সেই গল্পের মধ্যে একটা গান আমার এখনো মনে পড়ে শ্ৰীনাথ জ্যাঠামশায় সুর দিয়েছিলেন তাতে—
মন যে আমার কেমন করে।
বলি কারে, বলি কারে।
বিরহিণী বউ ঘাটে জল আনতে গিয়ে গাইছে।
সেই থিয়েটারে নবীন মুখুজ্জে মশায়ের ঘণ্টা দেওয়ার একটা মজার গল্প আছে। থিয়েটারে লোকজন আসবে, বাড়ির অন্যান্য সব ছেলেদের এক-একজনের উপর এক-একটা ভার তাঁদের রিসেপশন করবার। নবীনবাবু নির্মলের দাদামশায়, তাঁর উপরে ভার ছিল ঘণ্টা বাজাবার। একদিন হয়েছে কী, থিয়েটার হচ্ছে, নবীনবাবু সময়মত ঘণ্টা বাজিয়ে যাচ্ছেন। ইণ্টারভাল হল, দশ মিনিট বিশ্রাম। ও-ঘরে থিয়েটার, পাশের ঘরে সাপারের ব্যবস্থা ৷ ইণ্টারভালে সবাই এসেছেন এ-ঘরে খেতে, ও ঘরে নবীনবাবু ঘড়ি হাতে নিয়ে ঘণ্টা ধরে সোজা দাঁড়িয়ে। দশ মিনিট হয়েছে কি ঢং ঢং করে দিলেন ঘণ্টা পিটিয়ে, সাহেবসুবোরা ও অন্য অভ্যাগতরা কেউ হয়তো খেতে শুরু করেছেন কি করেন নি, সবাই দে ছুট। জ্যাঠামশায় বলেন, ব্যস্ত হবেন না, আপনারা নিশ্চিন্ত মনে খান, আপনাদের খাওয়া শেষ হলে আবার থিয়েটার শুরু হবে। জ্যাঠামশায় নীচে গিয়ে নবীনবাবুকে বলেন। নবীনবাবু অমনি বুকপকেট থেকে ঘড়ি বের করে বললেন, দেখো বাবা, দশ মিনিটের কথা, দশ মিনিট হয়ে গেছে কিনা—আমি পাঙ্চুয়ালি ঘণ্টা দিয়েছি।
শেষে জ্যাঠামশায় অনেক বুঝিয়ে তাঁকে ঠাণ্ডা করলেন।
অক্ষয় মজুমদার প্রায়ই আসতেন ইদানীং দীপুদার কাছে। তাঁর কাছে গল্প শুনেছি। তিনি বলতেন, জানো ভাই, থিয়েটার তো হচ্ছে, শহরে হৈ-হৈ ব্যাপার। রাস্তা দিয়ে আসছি একদিন, এক বৃদ্ধ আমাকে ধরে পড়লেন; বললেন, যে করে হোক আমাকে একখানা টিকিট দিন। আমি বৃদ্ধ হয়েছি, থিয়েটারের এত নাম শুনছি, হারমোনিয়াম বাজনা হবে, আমাকে একখানা টিকিট জোগাড় করে দিতেই হবে। কী আর করি, তাঁকে তো একখানা টিকিট দিলুম কোনোমতে জোগাড় করে। তিনি এসে থিয়েটার দেখে গেলেন, আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
তার পরদিন রাস্তা দিয়ে থেলো হুঁকো টানতে টানতে আসছি, পথে সেই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা; তিনি নিমতলার ঘাটে সকালবেলা গঙ্গাস্নান করে ফিরছেন। আমি বললুম, কেমন দেখলেন থিয়েটার। বৃদ্ধ একেবারে চেঁচিয়ে উঠলেন; বললেন, যা যা, তোর মুখদর্শন করতে নেই। যা যা, পাপিষ্ঠ কোথাকার, সকালবেলা গঙ্গাস্নান করে তোর মুখদর্শন করতে হল; সরে যা, সরে যা, কথা কবি নে। এই বলে যা-তা ভাষায় আমাকে গালগালি দিতে লাগলেন। আমি তো ভেবে পাই নে কী হল। বৃদ্ধ বললেন, পাপিষ্ঠ, শেষটায় বউটাকে মেরে ফেললি, তোর নরকেও স্থান হবে না।
থিয়েটারে ছিল গবেশের এক বউ গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়। বৃদ্ধ তখনো সেই অভিনয়ে মশগুল হয়ে আছেন, ভাবছেন সত্যিই গবেশবাবু বউকে মেরে ফেলেছে। মার মুখেও শুনেছি যে অভিনয় দেখে সত্যি বলে ভ্রম হত।
তার পর আমাদের ছেলেবেলায় যেটুকু মনে পড়ে—কিঞ্চিৎ জলযোগ, যাতে একটা পার্ট ছিল পেরুরামের, জ্যোতিকাকার লেখা। বাবামশায়ও তাতে ছিলেন। তার একটা গান আর হাসির হর্রা আমার এখনো কানে ভাসছে—
ও কথা আর বোলো না, আর বোলো না,
বলছ বঁধু কিসের ঝোঁকে—
ও বড়ো হাসির কথা, হাসির কথা,
হাসবে লোকে, হাঃ হাঃ হাঃ হাসবে লোকে।
সে কী হাসির ধুম! প্রাণখোলা হাসি, আজকের দিনে অমন হাসি বড়ো ‘মিস’ করি। হাসতে জানে না লোকে। তাঁদের ভিতরে অনেক দুঃখ, সংসারের জ্বালাযন্ত্রণা ছিল মানি, কিন্তু হাসতেন যখন—ছেলেমামুষের মতো প্রাণখোলা হাসি। শুনে মনে হত যেন কোনো দুঃখ কখনো পান নি।
০৮. তখনকার কালের নাটকের সূত্রপাতের কথা
তখনকার কালের নাটকের সূত্রপাতের কথা তো বলেছি, নাট্যজগতে তখন দীনবন্ধু মিত্তিরের প্রতাপ। তার নীলদর্পণ প্রসিদ্ধ নাটক। সেই নাটক হবার পর থেকেই নীলকর সাহেবরা উঠে গেল। পাদ্রী লং সাহেব তার ইংরেজি অনুবাদ করে জেলে যান আর কী। মকদ্দমা, মহা হাঙ্গামা। শেষে কালী সিং, যিনি বাংলায় মহাভারত লিখেছিলেন, তিনি লক্ষ টাকা জামিনে লং সাহেবকে ছাড়িয়ে আনেন। সে অনেক কাণ্ড। তার পর দীনবন্ধু মিত্তিরের ‘সধবার একাদশী’, আরো অনেক নাটক, সে-সব হয়ে তাঁর পালা শেষ হয়ে গেল। কালী সিংহের ‘হুতুম পেঁচার নকশা’, টেকচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল পুরোনো সমাজকে চতুর্দিক থেকে আঘাত করছে। বঙ্কিম তখন সাহিত্যজগতে উদীয়মান লেখক। তখন ন্যাশনাল আর বেঙ্গল দুটাে পাবলিক স্টেজ হয়ে গেছে।