দীপুদার একদিন কী হয়েছিল শোনো। কাঁপুনি শুরু হয়েছে, তিনি ছিলেন একতলার ঘরে, জানলা দিয়ে বাইরে এক লাফে বেরিয়ে এলেন। ঐ তো মোটা শরীর, নীচে ছিল কতকগুলি সোডার বোতল, পড়লেন তারই উপরে। ভাগ্যিস সেগুলি খালি ছিল নয়তো ফেটেফুটে কী একটা ব্যাপার হত সেদিন।
এমনিতরো এক-একটা কাণ্ড হতে লাগল।
ভূমিকম্পের পরদিন আমরা কয়েকজন মিলে এক জায়গায় বসে গল্প করছি, এমন সময়ে আমাদেরই বয়সী একজন ভলেণ্টিয়ার দেখি চেঁচাতে চেঁচাতে আসছে, ও মশাই, দেখুনসে। ও মশাই, দেখুনসে।
কী ব্যাপার।
বিলেত-ফেরত সাহেব চাঁইরা গামছা পরে পুকুরে নেবেছেন। ভূমিকম্পের ভয়ে কেউ আর চানের ঘরে ঢুকে আরাম করে চান করতে ভরসা পান না, কখন হঠাৎ আবার কাঁপুনি শুরু হবে। কয়েকজন দৌড়ে দেখতে গেল, আমরা আর গেলুম না। একটা হাসাহাসির ধুম পড়ে গেল। সাহেবি সাজ ঘুচল চাঁইদের এখানে এসে। আমাদের ভারি মজা লাগল।
পরদিন খবর পাওয়া গেল, একখানি টেস্ট ট্রেন যাবে কাল। তাতে ‘রিস্ক্’ আছে। ট্রেন নদীর এ পারে আসবে না, নদী পেরিয়ে ও পারে ট্রেন ধরতে হবে। আমরা সবাই যাবার জন্য ব্যস্ত ছিলুম। রবিকাকাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, বাড়ির জন্য ওরকম ভাবতে তাঁকে কখনো দেখি নি—মুখে কিছু বলতেন না অবশ্য, তবে খবর পাওয়া গিয়েছিল কলকাতায় বাড়ি দু-এক জায়গায় ধসে গেছে, তাই সবার জন্যে ভাবনায় ছিলেন খুব। আমরাও ভাবছিলুম, তবে জানি মা আছেন বাড়িতে, কাজেই ভয়ের কোনো কারণ নেই। অন্যরাও যাবার জন্যে উদ্গ্ৰীব হয়ে উঠলেন।
ঘোড়ার গাড়ি একখানি পাওয়া গেল, ঠিকেগাড়ি। তাতে করেই আসতে হবে আমাদের নদীর ব্রিজের কাছ পর্যন্ত। আমরা কয়জন এক গাড়িতে ঠেসাঠেসি করে; দীপুদা উঠে বসলেন ভিতরে, ব্যাপার দেখে আমি একেবারে কোচ-বক্সে চড়ে বসলুম। যাক, সকলে তো নদীতে এসে পৌঁছলুম। এখন নদী পার হতে হবে। দু রকমে নদী পার হওয়া যায়। এক হচ্ছে রেলওয়ে ব্রিজের উপর দিয়ে; আর হচ্ছে নদীতে জল বেশি ছিল না, হেঁটেই এ পারে চলে আসা। ব্রিজটা ভূমিকম্পে একেবারে ভেঙে পড়ে যায় নি অবশ্য; কিন্তু জায়গায় জায়গায় একেবারে ঝুর্ঝুরে হয়ে গেছে, তার উপর দিয়ে হেঁটে যাবার ভরসা হয় না। আমরা ঠিক করলুম হেঁটেই নদী পার হব। রবিকাকারও তাই ইচ্ছে। চাঁইরা ঘাড় বেঁকিয়ে রইলেন—তাঁরা ঐ ব্রিজের উপর দিয়েই আসবেন। আমরা তো জুতো খুলে বগলদাবা করে, পাজামা হাঁটু অবধি টেনে তুলে, ছপ্ ছপ্ করে নদী পেরিয়ে ও পারে উঠে গেলুম। ও পারে গিয়ে দেখি চাঁইরা তখন দু-এক পা করে এগোচ্ছেন ব্রিজের উপর দিয়ে। রেলগাড়ি যায় যে ব্রিজের উপর দিয়ে তা দেখেছ তো? একখানা করে কাঠ আর মাঝখানে খানিকটা করে ফাঁক। ঝর্ঝরে ব্রিজ, তার পরে ঐ রকম থেকে থেকে ফাঁক—পা কোথায় ফেলতে কোথায় পড়বে। চাঁইরা তো দু-পা এগিয়েই পিছোতে শুরু করলেন। ব্রিজের যা অবস্থা আর এগোতে সাহস হল না তাঁদের। যেই-না চাঁইরা পিছন ফিরলেন, আমাদের এ পারে রব উঠল—ঘুরেছে, ঘুরেছে। আরে কী ঘুরেছে, কে ঘুরেছে। সবাই ফিসফাস করছি—চাঁইরা ঘুরেছে, ঘুরেছে, ঘুরেছে। মহাফুর্তি আমাদের। তার পর আর কী, দেখি আস্তে আস্তে তারা নদীর দিকে নেমে আসছেন। সাহেবি সাজ তো আগেই ঘুচেছিল, এবার সাহেবিয়ানা ঘুচল। জুতোমোজা খুলে প্যাণ্টুলুন টেনে তুলতে তুলতে চাঁইরা নদী পার হলেন।
আমরা ঠিক করলুম ট্রেনের প্রথম কামরাটা নিতে হবে আমাদের দখলে। রবিকাকাকে নিয়ে আমরা আগে আগে এগিয়ে চললুম। প্রথম কামরায় আমরা বন্ধুবান্ধবরা মিলে যে যার বিছানা পেতে জায়গা জুড়ে নিলুম। দীপুদা দু বেঞ্চের মাঝখানে নীচে বিছানা করে হাত-পা ছড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। রবিকাকাও বেঞ্চের এক পাশে বসে কাউকে ওঠানামা করতে দিচ্ছেন না পাছে জায়গা বেদখল হয়ে যায়। বৈকুণ্ঠবাবু ছিলেন খুব গল্পে’ মানুষ তা আগেই বলেছি, তাঁকে নিলুম ডেকে আমাদের কামরায়—বেশ গল্প শুনতে শুনতে যাওয়া যাবে। চাঁইদের জব্দ করে আমরা তো খুব খুশি। রবিকাকাও যে মনে মনে ওঁদের উপর চটেছিলেন মুখে কিছু না বললেও টের পেলুম তা। একজন পাড়াগেঁয়ে সাহেব, রবিকাকার বিশেষ বন্ধু ছিলেন তিনি, খুব চালের মাথায় ঘোরাঘুরি করছেন আর মুখ বেঁকিয়ে বাঁকা ইংরেজিতে খোঁজ নিচ্ছিলেন আমাদের কামরায় জায়গা আছে কি না। রবিকাকা যেন চিনতে পারেন নি এমনি ভাব করে চুপ করে বসে রইলেন। দীপুদা শুয়ে ছিলেন—পিট্পিট্ করে তাকিয়ে দেখে নিলেন কে কথা কইছে। দেখেই তিনি বলে উঠলেন, আরে, তুই কোত্থেকে। অমুক জায়গার অমুক না তুই।
আর যায় কোথায়—কোথায় গেল তাঁর চাল, কোথায় গেল তাঁর সাহেবিয়ানা, ধরা পড়ে যেন চুপসে এতটুকু হয়ে গেলেন।
তখন রবিকাকাও বললেন, ও তুমি অমুক, আমি চিনতেই পারি নি তোমাকে।
বেচারি পাড়াগেঁয়ে সাহেবটি কাঁচুমাচু হয়ে যায় আর কি।
ট্রেন ছাড়ল, গল্পগুজবে মশগুল হয়ে মহা আনন্দে সবাই বাড়ি ফিরে এলুম। এইভাবে আমাদের বাংলা ভাষার বিজয়যাত্রা আমরা শেষ করলুম।
০৬. এইবারে হিন্দুমেলার গল্প বলি শোনো
এইবারে হিন্দুমেলার গল্প বলি শোনো। একটা ন্যাশনাল স্পিরিট কী করে তখন জেগেছিল জানি নে, কিন্তু চার দিকেই ন্যাশনাল ভাবের ঢেউ উঠেছিল। এটা হচ্ছে আমার জ্যাঠামশায়দের আমলের, বাবামশায় তখন ছোটো। নবগোপাল মিত্তির আসতেন, সবাই বলতেন ন্যাশনাল নবগোপাল, তিনিই সর্বপ্রথম ন্যাশনাল কথাটার প্রচলন করেন। তিনিই চাঁদা তুলে হিন্দুমেলা শুরু করেন। তখনো ন্যাশনাল কথাটার চল হয় নি। হিন্দুমেলা হবে, মেজোজ্যাঠামশায় গান তৈরি করলেন—